হলফনামার কোন তদন্ত হয় না!

নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা হলফনামা জমা দেন৷ কয়েকদিন সংবাদপত্রে এই হলফনামা ফলাও করে ছাপা হয়৷ এই পর্যন্তই৷ এরপর হলফনামা ধরে কোন তদন্ত হয় না৷

কেউ ঠিক তথ্য দিলেন, না ভুল তথ্য দিলেন, কেউ সেটা যাচাই করে না৷ অথবা পাঁচ বছরের ব্যবধানে একজন মন্ত্রী বা এমপি কীভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেন সে তথ্য কেউ খুঁজে বের করেন না৷ ফলে প্রশ্ন উঠেছে আদৌ কি হলফনামার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে?

বাংলাদেশে নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতে চান, তাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের তথ্য হলফনামায় উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়৷ আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক প্রার্থীর সম্পদের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে কয়েকশ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে৷ অনেক প্রার্থীর নিজের নামে সম্পদ তুলনামূলক কম বাড়লেও তাদের স্ত্রীর নামে সম্পদের পরিমাণ শত গুণ পর্যন্ত বেড়েছে৷

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে এখন যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আগেই হারিয়ে গেছে৷ এখন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন, এসব দুর্নীতিবাজ লোকজনকে আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দেবেন তাহলে পারেন৷ প্রধানমন্ত্রী চাইলে তাদের মনোনয়ন দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন৷ দুর্নীতির মামলায় বিরোধীদের যে বিচার হচ্ছে হোক, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই৷ কিন্তু সরকারের মন্ত্রী এমপিদের হলফনামা ধরে যদি তদন্ত হয় তাহলে দুর্নীতির মামলায় অনেকেই জেলে যাবেন৷”

২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর হলফনামা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে একটা কলাম লিখেছিলেন অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘মন্ত্রী-সাংসদেরা কি ধনী হতে পারেন না? যদি বৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে সম্পদ বাড়ান? আইন বলে, মন্ত্রীরা তাদের বেতন-ভাতাদি ছাড়া আর কোনো উপায়-অর্জন করতে পারবেন না৷ কোনো বৈধ ব্যবসাও করতে পারবেন না৷ এটা সংবিধান নিষেধ করে দিয়েছে৷ আট ধরনের সাংবিধানিক পদের বেতন-ভাতাসংক্রান্ত বড় একটা অনুচ্ছেদ আছে সংবিধানে৷ ১৪৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী, বিচারপতি, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি আট ধরনের পদ ১৪৭ অনুচ্ছেদের আওতায় পড়ে৷ পাঠক যদি শপথ নিয়ে মন্ত্রী বনে যান, তাহলে ১৪৭ অনুচ্ছেদটি আপনাকে জানতে হবে৷ মন্ত্রী ‘…কোন লাভজনক পদ কিংবা বেতন-ভাতাদিযুক্ত পদ বা মর্যাদায় বহাল হইবেন না কিংবা মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যযুক্ত কোন কোম্পানি, সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনায় কোনরূপ অংশগ্রহণ করিবেন না৷”

ফলে একজন মন্ত্রী সরকারি সুবিধার বাইরে কোন আয় করতে পারবেন না৷ পারিবারিক সম্পত্তি থেকে যদি কোন আয় আসে সেটাও পরিবারের লোকজন পাবেন৷ তাহলে প্রশ্ন হল, মন্ত্রীদের আয় কীভাবে শতগুণ বাড়ছে? কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের সবগুলো সংবাদপত্রে যেটা শিরোনাম হচ্ছে, তার মধ্যে আছে হলফনামার তথ্য৷

হলফনামার প্রয়োজন হল কেন? এটা দেখার দায়িত্ব কার? জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘হলফনামায় প্রার্থীর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত সবকিছু খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে বিধায়ই এই প্রভিশনটা দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেটা যথাযথভাবে পালন করা হয় না৷ এটা দেখার দায়িত্ব মূলত তিনটি প্রতিষ্ঠানের৷ প্রথমত নির্বাচন কমিশনের৷ দ্বিতীয়ত দুর্নীতি দমন কমিশনের এবং তৃতীয়ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের৷ প্রত্যেক প্রার্থীই আয়কর রিটার্ন জমা দেন৷ সেটার সঙ্গে হলফনামার মিল আছে কিনা সেটা রাজস্ব বোর্ড দেখবে৷ কেউ দুর্নীতি করে টাকা উপার্জন করেছেন কিনা সেটা দেখবে দুর্নীতি দমন কমিশন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল কেউ সেটা দেখেন না৷ নির্বাচন কমিশন তো নির্বাচনের পরও হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে কোন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারেন৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একজনের ক্ষেত্রেও এমনকি ঘটেনি৷”

মনোনয়নপত্রের সাথে প্রার্থীর হলফনামা জমা দেয়ার নিয়ম কার্যকর হয় ২০০৮ সাল থেকে৷ যার মধ্যে প্রার্থীর আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব, তার উপর নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে৷ হলফনামায় দেওয়া সম্পদের তথ্য অনুযায়ী, আয় ও সম্পদ বাড়ার পর তা নিয়ে সমালোচনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়৷ বরং এর আগের নির্বাচনগুলোতেও অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে একই ধরনের সমালোচনা সামনে এসেছে৷

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘‘আমরা এটা শুধু আইনের মধ্যেই এনেছি, এমনটি নয়৷ আমরা পুরো তালিকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠিয়েছিলাম৷ পাশাপাশি হলফনামাগুলো দেখার জন্য নির্বাচন কমিশনে আলাদা জনবলের ব্যবস্থা করেছিলাম৷ কিন্তু তখন রাজস্ব বোর্ড থেকে কোন উত্তর পাইনি৷ পাশাপাশি সেই অতিরিক্ত জনবল এখনও আছে কিনা আমি জানি না৷ তবে হলফনামায় কেউ ভুল তথ্য দিলে সেটা দেখা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷ আবার কেউ দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জন করলে সেটা দেখবে দুর্নীতি দমন কমিশন৷”

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন ২০১৪ সালের নির্বাচন অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ৪৮ জন প্রার্থীর ২০০৮ সালের হলফনামা ও ২০১৪ সালের হলফনামা পর্যালোচনা করেছিল৷ তখন প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল যে, বেশ কয়েক জন প্রার্থীর আয় ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৮ হাজার গুণ পর্যন্ত বেড়েছে৷ সবশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এতে অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ৫৩ জন প্রার্থী যারা দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের হলফনামার আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সুজন৷ সেখানে বলা হয়, সর্বমোট ৫৩ জন প্রার্থীর আয় গড়ে ১০৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ আয় বৃদ্ধির এই হার ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫২ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে৷

হলফনামার সঙ্গে আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান বর্তমান কমিশন কার স্বার্থে বাতিল করেছে? এমন প্রশ্ন তুলে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘হলফনামার বর্তমান আট দফার ছকে পরিবর্তন আনা দরকার৷ শুধু অংশগ্রহণমূলক নয়, নির্বাচন হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক৷ নির্বাচনে প্রার্থী বেছে নেওয়ার বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকতে হবে৷ প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে মনগড়া তথ্য দেন৷ কারণ তারা জানেন, এসব যাচাই-বাছাই হবে না৷ অথচ মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিল, এমনকি নির্বাচিত হয়ে গেলেও ফল বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন৷”

সুজন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘‘প্রার্থীর হলফনামা কোনোভাবেই যাচাই করা যাচ্ছে না৷ দুর্ভাগ্যবশত কোনো নির্বাচন কমিশনই এটি করেনি৷ দায়িত্ব এড়িয়ে চলছে৷ অথচ এই হলফনামা যাচাই করার কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব৷”

হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেক মন্ত্রী কৃষি থেকে আয় করেছেন বা মৎস্য চাষ থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করেছেন৷ অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘কৃষি বা মৎস্য থেকে মুনাফা অর্জনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নিশ্চয় কোনো না কোনো ভূমিকা ছিল, সংবিধানের ভাষায়, পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনায় নিঃসন্দেহে ভূমিকা ছিল৷ অর্থাৎ কোনো দুই নম্বরি হয়নি, সেটা ধরে নিলেও মন্ত্রীদের ব্যবসা করাটাই ছিল সংবিধানের পরিপন্থী৷ বেতন-ভাতার বাইরে উপরি আয় করে মন্ত্রীরা স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন৷ সংবিধান লঙ্ঘনের সাজা মন্ত্রী-সাংসদেরাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে৷ সংবিধানের ৭ক(৩) অনুচ্ছেদে সাজার বিধানটা বলা আছে৷”

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই অকার্যকর হয়ে গেছে৷ এগুলো সেভাবে গড়ে তোলা হয়নি বা গড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া হয়নি৷ তাদের কাজ করতেও দেওয়া হয়নি৷ সবকিছুই কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে৷ ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের যে ক্ষমতা সেটা তাদের প্রয়োগ করতে দেওয়া হয় না৷ আমাদের নৈতিক স্খলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যারা সংবিধান রক্ষার জন্য শপথ নেন তারাই নিজেদের স্বার্থে যা ইচ্ছে তাই করেন৷ এরজন্য তাদের কোন জবাবদিহিও করতে হয় না৷ যারা এই জবাবদিহি নিশ্চিত করবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারাই দুর্বল করে রেখেছেন৷ ফলে প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছেন৷”

এসএইচ-০৪/১৫/২৩ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)