স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহীদের আতঙ্কে আওয়ামী লীগের নৌকা!

নিজের দলের ‘স্বতন্ত্র’ ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে আওয়ামীলীগের নৌকার প্রার্থীরা। স্বতন্ত্রদের নিবৃত্ত করার জন্য তারা শেখ হাসিনার সহায়তা কামনা করছেন বলেও জানা গেছে৷

জোটের যে প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক পেয়েছেন বা এখনো পাওয়ার আশায় আছেন, তারাও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছেন। আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, “আজ এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী অনড়। তিনি স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহীদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না। কালকে কী হবে তা বলতে পারছি না।” আর প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানের কারণে অনেক আওয়ামী লীগ প্রার্থী, এমনকি বেশ কিছু ভিআইপি প্রার্থীর ঘুম হারাম। তারা এলাকায় না গিয়ে ঢাকায় তদবিরে ব্যস্ত। তারা চাইছেন প্রকাশ্যে না হলেও যেন কৌশলে স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দেয়া হয়। যে যার মতো করে এই তদবির করছেন বলে জানা গেছে।

আর ১৪ দলীয় জোটের যে সাত জনের আসন নিয়ে সমঝোতা হয়েছে, তারা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েও ভয়ে আছেন। তারাও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন বিদ্রোহী বা ডামি যারা আছেন, তাদের বসিয়ে দেয়ার জন্য। আর এজন্য হাতে সময় আছে মাত্র দুই দিন। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর মধ্যে যা করার করতে হবে। তাই নৌকার সবাই এখন স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দিতে শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপের জন্য মরিয়া।

এদিকে প্রাথমিক পর্যায়ে জেলা রিটানিং কর্মকর্তারা অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করলেও তারা অনেকেই আবার আপিল মামলা জিতে ফিরে এসেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল হয়েছে। এরমধ্যে ভিআপি প্রার্থীও আছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি ছাড়া একপাক্ষিক নির্বাচনেও নির্বাচনের মাঠে নামার আগেই ব্যাপক টেনশনে আছেন নৌকা প্রতীক পাওয়া অনেক প্রার্থী।

নির্বাচনি এলাকায়ও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে বিদ্রোহী, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ছে। এরই মধ্যে সংঘর্ষে পিরোজপুরে একজন নিহত হয়েছেন। আর মনোয়নপত্র দাখিলের পর স্বতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন, সেসব স্থানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

গত ২৭ নভেম্বর ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। ওই দিন সকালে শেখ হাসিনা জানিয়ে দেন, দলীয় নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে ও ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এর ফলে ৩০০ আসনের মধ্যে ২২৯টি আসনেই মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে স্বতন্ত্রদের বড় একটি অংশ বাদ পড়লেও তাদের অধিকাংশই আবার আপিলে ফিরে এসেছেন। ফলে যাচাই-বাছাইয়ে স্থানীয় পর্যায়ে তারা যে ‘ম্যাকানিজম’ করেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। তাদের মধ্যে ভিআইপিরাও আছেন। গত পাঁচ দিনে ২৫৭ জন প্রার্থীতা ফিরে পেয়েছেন। শুক্রবার শেষ দিনের আপিল নিস্পত্তি শেষে জানা যাবে কতজন ফেরত পেলেন এবং কতজনের বাতিল হলো।

এদিকে ১৪ দলকে সাতটি আসন দেয়ার পর তারা আরো দুই-একটি আসন পেতে পারে। আর জাতীয় পার্টি চায় ৪০টি আসন।

আয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন,” প্রার্থী হিসেবে আমি মনে করি আমার প্রতিদ্ব›দ্বী যে কোনো প্রার্থীই আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীও আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। বিএনপি যদি নির্বাচন করতো তাহলে তাদের প্রার্থীর সঙ্গে তো আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো। তাহলে এখন কেন কেন করবো না।” তবে তিনি মনে করেন,” এবারের চিত্র আলাদা। বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় প্রধানত স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।”

তিনি জানান, “প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্রদের ব্যাপারে এখানো আগের অবস্খানেই আছেন। স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দেয়া বা তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার কোনো ইচ্ছা তার নাই। সেটা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বা অন্য কোনোদল বা নির্দলীয় স্বতন্ত্র হোক। তিনি চান একটি প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একই কথা বলেছেন।”

স্বতন্ত্রদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সমর্থক ও কর্মীদের সংঘাতের ব্যাপারে তিনি বলেন,” কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এটা বাড়বেনা, নির্বাচন শান্তিপূর্ণই হবে।”

আওয়ামী লীগের কয়েক জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কমপক্ষে ১৩০টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে দলের বিদ্রোহীসহ এক বা একাধিক শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮০টি আসনে দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য তাদের কাছে ধরাশায়ী হতে পারেন। ওই নেতারা জানান, দলের শীর্ষ পর্যায়ে যে হিসাব আছে তাতে তারা মনে করেন বিএনপি ছাড়া এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও আওয়ামী লীগ ১৫০টির বেশি আসন পাবে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চান। চান উল্লেখযোগ্য ভোটারের উপাস্থিতি। আর স্বতন্ত্র যারা জিতবেন তারা আধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। ফলে ওই আসনগুলো আয়ামীলীগেরই থাকবে। শেখ হাসিনা তাই জানিয়ে দিয়েছেন,” মনোনয়ন দিয়েছি এখন নিজের যোগ্যতায় জিতে আসুন।”

এদিকে শুধু স্বতন্ত্র না কেউ কেউ নিজেদের দেয়া ডামি প্রার্থীদেরও ভয় পাচ্ছেন। কয়েকটি আসনে ডামি প্রার্থীও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

সার্বিক পরিস্থিকি বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন,” যদি পরিস্থিতি এরকমই থাকে তাহলে এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্ররা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হবেন। এটা আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ না হলেও কোনো কোনো প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। নানা ধরনের চিন্তা তৈরি হচ্ছে, তার একটি হলো কেউ কেউ বলছেন, তারা নৌকার বিরুদ্ধে নয়, নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে।” তার কথা,” এবারের নির্বাচনটা এখন পর্যন্ত অভিনব। আগে হয়তোবা সারাদেশে দুই-একজন শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখা যেতো। এবার অনেক। ডজন ডজন। যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ফেয়ার হয়, সহিংসা না হয় আর জাতীয় পার্টি আরো শক্তিমত্তা দেখাতে পারে তাহলে সব মিলিয়ে নতুন একটা পরিস্থতি হতে পারে।”

তিনি বলেন, ” বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় এবং প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্রদের উৎসাহিত করায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সুরক্ষা দেয়ার কথাও বলছেন। এখন পর্যন্ত তাœর যা মনোভাব তাতে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চাচ্ছেন। চাচ্ছেন কেন্দ্রে যেন ভোটার উপস্থিতি বেশি হয়।”

“তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে হয়তো বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্রদের উৎসাহিত করার বা সুরক্ষা দেয়ার বিষয়টি এরকমভাবে হতো না। এত স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীও হতো না,” মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।

এসএইচ০৩/১৬/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)