নির্বাচনী পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠছে!

হামলা, সংঘাত আর হুমকির ঘটনা বাড়ছেই। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে পরিবেশ তত অস্থির হয়ে উঠছে। আর এই হামলা হুমকিতে এগিয়ে আছেন আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী ও কর্মীরা। এরই মধ্যে ৩ জানুয়ারি থেকে মাঠে থাকবে সেনাবাহিনী।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, এপর্যন্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের ২৫৮টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৫৯টির নিস্পত্তি হয়েছে। এরমধ্যে ৬৪ জনের ব্যাপারে অধিকতর তদন্ত হচ্ছে। আর তিনজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। জানা গেছে ওই তিন প্রার্থীই নৌকার। তিনি বলেন,”২৯ ডিসেম্বর থেকে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনের জন্য মাঠে থাকবেন। তখন আশা করি পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে।”

প্রধানমন্ত্রী সংঘাত সংঘর্ষের কাজে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশন শোকজ করছে , নোটিশ দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এসবকে পরোয়া করছেন না আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তারা টার্গেট করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। তারাই এখন নৌকার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন। তাই তারাই হামলা ও হুমকির শিকার হচ্ছেন বেশি।

নির্বাচনের প্রচার শুরু হয় ১৮ ডিসেম্বর। এরইমধ্যে মাদারীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক সেকান্দার খাঁ নামে এজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তাহমিনা বেগম। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য নৌকার প্রার্থী ও সংসদ সদস্য আব্দুস সোবহান গোলাপের লোকজনকে দায়ী করলেও গোলাপ তা অস্বীকার করেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার তাহমিনা বেগমের কর্মীদের মিছিলে হাত বোমা হামলা হয়।

আবার নৌকার সমর্থকেরাও কয়েক জায়গায় হামলার শিকার হয়েছেন। টাঙ্গাইল-৫ আসনে রোববার রাতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর গুলির ঘটনা ঘটে। এতে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ এরইমধ্যে ওই গুলির ঘটনায় জড়িত অভিযোগে দুইজনকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ধরে হিসাব করে দেখা যায় আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৯২টি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, মিছিলে গুলি ও বোমা হামলা, কোপানোসহ আরো অনেক ঘটনা আছে। আর হুমকি দেয়া হচ্ছে অহররহ। হুমকির মধ্যে চোখ উপড়ে ফেলা, হাত-পা ভেঙে ফেলা, এলাকা ছাড়া করা সহ আরো অনেক ধরনের হুমকি আছে। এসব হুমকির কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। অন্যদিকে প্রার্থীদের সমাবেশ ও মিছিলে হত্যাসহ নানা মামলার আসামিদেরও দেখা যাচ্ছে। তারা এই সুযোগে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছেন। বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুর সমাবেশে দুইদিন আগে বক্তৃতা করেন বিএনপি নেতা ও নাশকতা মামলার আসামি ইউপি চেয়ারম্যান মতিউর রহমান ওরফে রাজা। একদিন পর অবশ্য পুলিশ রাজাকে গ্রেপ্তার করে।

নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত ২২৮ জনকে শোকজ করা করেছে। এর মধ্যে নৌকার প্রার্থী ৯৭ জন। অন্যরা বেশির ভাগই স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের মধ্যে ৫৮ জন বর্তমান সংসদ সদস্য।

আর ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৬১টি জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো এলাকায় হামলা ও হুমকির মুখে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিরাপত্তা না পেয়ে প্রচার কাজে নামতে পারছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নির্বাচন কমিশন কয়েকটি ঘটনায় প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছে। হবিগঞ্জের ডিসিসহ ওই জেলার তিন থানার ওসিকে সোমবার প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফরিদপুরের এসপিকে মঙ্গলবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে ফরিদপুর সদরের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা ও নির্বাচনী অফিস ভাঙচুরের ঘটনা বেশ আলোচিত। চাঁদপুরের মতলবেও একই পরিস্থিতি চলছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী এম ইশফাক আহসানের কর্মী সমর্থকেরা ধারাবাহিক হামলার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামেরও কয়েকটি আসনে একই পরিস্থিতি চলছে।

ঝিনাইদহ-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি আব্দুল হাই ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। আব্দুল হাই এর বিরুদ্ধে দুইটি ঘটনায় আলাদা মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এছাড়া বরগুনা-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে তলবের পাশাপাশি কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কমিশন।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, “প্রার্থীরা শক্তিশালী হলে কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় বলে কিছু জায়গায় সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। যার যেখানে শক্তি সেখানে সে শক্তি দেখানোর চেষ্টা করে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে। ভোট যেন শান্তিপূর্ণভাবে হয়। ভোটাররা যাতে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ করা যাবে না। ভোট হবে সুষ্ঠু।”

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও নৌকার প্রার্থীরা থামছে না না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “থামছেনা, কিন্তু যখন ধরা খাবে তখন থেমে যাবে।”

তার কথা, “নির্বাচন কমিশন অতীতের চেয়ে আরো দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে।”

তবে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন,”এখন প্রার্থীরা সোনার হরিণ ধরার চেষ্টা করছেন। এমপি হওয়া মানে ক্ষমতা, টাকা। এমপি হলে অর্থ বিত্তের মালিক হওয়া যায়। অন্যকে মালিক করা যায়। অন্যায় অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। ফলে যেকোনো উপায়ে তারা এমপি হতে চান। আর এই কারণেই সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলার পরও নৌকার প্রার্থীরা থামছেন না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন স্বার্থের প্রশ্ন আসে তখন কেউ কারো কথা শুনে না।”

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “আমরা সব ব্যবস্থাই নিচ্ছি। কাাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। তবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া আছে। শোকজ, জবাব, তদন্ত এই প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করতে হয়। ফলে একটু সময় লাগে। আমরা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছি তা প্রার্থীদের বিরুদ্ধে।”

আগামী ৩ জানুয়ারি থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে সেনাবাহিনী। তবে ২৯ ডিসেম্বর থেকে সেনা মোতায়েন শুরু হবে। অশোক কুমার দেবনাথ জানান তারা ২৯ ডিসেম্বর থেকে ক্যাম্প স্থাপনের কাজ শুরু করবেন। মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন ৩ ডিসেম্বর থেকে।

এসএইচ-০২/২৬/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)