বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন

নারী ক্ষমতায়ন হলো নারী ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া। একটি দেশের উন্নয়ন তথা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নকে বিবেচনা করা হয়। অথচ নারীদের প্রতি বৈষম্য যেন আমাদের নিত্যদিনের স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমান সুযোগের ব্যবস্থা করে সমান অধিকার নিশ্চিত করা গেলে আমরা নারী শক্তির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে পারি। এজন্য প্রয়োজন তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ এবং এ অংশগ্রহণে আমাদের সবার সহযোগিতা একান্ত জরুরি ও কাম্য। উপরিউক্ত ক্ষেত্রে তাদের বৈষম্যহীন অংশগ্রহণই পারে দেশকে উন্নত ও সভ্য করে তুলতে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই কাজ মোটেও সহজ নয়। এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরুষের সহযোগিতা।

আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা অনেক পিছিয়ে। সবকিছু বিবেচনা করলে তার একটাই কারণ দাঁড়ায়, আর তা হচ্ছে গোঁড়ামি। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে গোঁড়ামি। অনেক প্রতিবন্ধকতার পরেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুরুষের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের। দেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা, পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ চলছে। বাস্তবে নারী তার মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে সভ্যতার সব অগ্রগতি এবং উন্নয়নে করেছে সম অংশীদার। আর তাই বদলে গেছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারীর কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বীকৃতি। তৃণমূলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসন, পুলিশ, বিচার, সামরিক, বেসামরিক প্রশাসনের সর্বস্তরে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেন। তিনি জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।

বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের রোল মডেল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি সারা বিশ্বে আজ প্রশংসিত। ঘরে-বাইরে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশে নিশ্চিত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতা প্রমাণ করছেন, কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন। নারীরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, পর্বত জয় করছেন, অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও। নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তো বটেই, উন্নত অনেক দেশ থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। নারী-পুরুষের সমতা (জেন্ডার ইক্যুইটি) প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছে। কিছু হতাশা থাকলেও নারীর ক্ষমতায়নে দেশের অর্জন অনেক।

হার্ভাড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। ডব্লিউইএফের হিসাবে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে ৪৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ। এ অবস্থানের কারণই হচ্ছে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কিছু নীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে সরকার। যার ফলে এখন সর্বক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণ তুলনামূলক বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খেলাধুলা, শিক্ষা, ক্যারিয়ার, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণে নারীর সাফল্য আজ পরিলক্ষিত হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেত্রী, স্পিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে নারী। এসব কারও দয়া-দাক্ষিণ্যে পাওয়া নয়, নারীর যোগ্যতায় অর্জন।

নারী উন্নয়নের অন্যতম সূচক হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের শ্রমিকদের ৭০ শতাংশের বেশি নারী। আবার দেশের বৃহত্তম সেবা খাত হলো স্বাস্থ্যসেবা। এ খাতেও কর্মরতদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীদের যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার, অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়নসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারী উন্নয়ন আজ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে অনুতাপের বিষয় এই যে, আমাদের দেশের নারীরা তার যোগ্যতা অনুযায়ী খুব বেশি লাভবান হতে পারছে না। আমরা এখনও তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারিনি। তাই আমাদের সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে উচিৎ নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করে তার যোগ্যতা অনুযায়ী সামনে যাওয়ার পথ সুগম করে দেয়া, সহযোগিতা করা, তাদের ভালোবাসা, ভালোবাসা পাওয়া, সম্মান করা, তাদের সম্মান পাওয়া।

এআর-০৫/২৬/১২ (মারিয়া বিনতে মতিন)