জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কারা হতে যাচ্ছেন!

দেশের পরবর্তী জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কারা হতে যাচ্ছেন, এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।

ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন।

ঢাকার তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “অনেকেই জিতেছে, বিরোধী দল কারা হবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় দূরে নয়। জাতীয় পার্টির অনেকেই জিতেছেন এবং ১৪ দলের ২ জনের মতো জিতেছেন।”

“যিনি লিডার অব দ্য হাউজ হবেন তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। তার মানে নতুন প্রধানমন্ত্রী, নতুন লিডার অব দ্য হাউজ পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বুঝে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবেন”, জানান ওবায়দুল কাদের।

রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ এক আলোচনায় বলেছেন, “অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রক্সি বিরোধী দল হবে। ‘আওয়ামী স্বতন্ত্র লীগ’ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে বিরোধী দল গঠন করবে।”

“এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে অনেক রাজনীতিবিদ নিজেদের ক্লাউন প্রমাণিত করে ফেলেছেন। তারা আর রাজনীতিবিদ থাকছেন না, সার্কাসের ক্লাউন হয়ে থাকবেন বাকি জীবন”, বলেন মি. আহমেদ ।

রোববার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, “জাতীয় পার্টিকে কোরবানি দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু হয় কিনা তা নিয়ে আমরা কিছুটা শঙ্কিত!”

সে বিষয়টি উল্লেখ করে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “তারা বরাবরই আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে নির্বাচন করে। তবে আলাদা মার্কায়। আসন ভাগাভাগি হলেও সে সবের বিপরীতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় তার এ আশঙ্কা ছিল।”

“এখন জাতীয় পার্টিকে তিতা বড়িটা খেতে হবে। সংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করতে হলে জাতীয় পার্টি আর বিরোধী দল থাকতে পারবে না। বিরোধী দলীয় রাজনীতির যে রূপান্তরটা হলো এটা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলবে আরো কিছুদিন” যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পর জাতীয় সংসদে বিরোধী দল তৈরির অংশ হিসেবে বিএনপিকে ভাঙ্গার তৎপরতা ছিল।

তৃণমূল বিএনপি তৈরি করা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থী – সব ধরনের প্রচেষ্টাই ছিল সরকারের।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “এখন ‘হার ম্যাজেস্টিস অপজিশন’ টাইপ হয়ে গেলো। তারা লয়্যাল অপজিশন হবে তাতে কোনও সন্দেহ নাই। এখানে আওয়ামী স্বতন্ত্র-লীগকে হয়তো পরবর্তীতে কিছু একটা নাম দিবে, যদি তাদের নেতা চান।”

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও বেশ কিছু সুপরিচিত নেতার পরাজয়কে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম শহীদ খান বলছেন, “এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু থাকবে না।”

“কারণ যারা নির্বাচন করছেন তারা নৌকা মার্কা, না হলে নৌকা মার্কার ডামি প্রার্থী। ১৪ দলের ছয়জন প্রার্থীও নৌকা মার্কা নিয়েই সংসদে যাবেন। জাতীয় পার্টিও জনগণকে আগেই ধারণা দিয়েছেন তারা নৌকারই লোক। ফলে এই সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু নেই”, মনে করছেন তিনি।

তিনি বলেন, “বিরোধী দল থাকবে না কিন্তু বিরোধী গোষ্ঠী থাকবে। বাংলাদেশে একটা নতুন গণতন্ত্র হতে যাচ্ছে।”

খান আরও বলেন, “নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, শিডিউল ঘোষণার পর থেকে সবাই জানে। যে নাটকীয়তা হয়েছে, তখন পরিষ্কার বুঝা গেছে কারা জিতবে। কয়েকটা আসন, যেখানে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সে সব ছাড়া নৌকা মার্কায় যারা নির্বাচন করবে তারাই জিতবে।”

“২০১৪, ২০১৮, ২০২৪-র নির্বাচন আসলে একই সূত্রে গাঁথা। ভিন্ন রূপকল্প রয়েছে, তবে, মূল লক্ষ্য ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় থাকা। তারা যাবতীয় সব প্ল্যান করেছেন। এ, বি ,সি অনুযায়ী কাজ করেছেন। সে লক্ষ্যে কাজ হয়েছে। ক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হবে না। শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন”, বলছিলেন এই সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব।

কার্যকর বিরোধী দল সরকারের সাহায্যকারী উল্লেখ করে মি. খান আরও বলেন, “আমলা, পুলিশ এমন যারা পরিচালনাকারী তারা ঠিক মতো কাজ করছে কি না, তা বোঝার জন্যও সংসদে বিরোধী দল দরকার। সরকারকে তারা সাহায্য করবে। তবে আমাদের দেশে বিরোধী দলকে মনে করা হয় শত্রু। (শাসকরা) তাকে কোনও ভাবেই সহ্য করতে পারে না।”

সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আবার মনে করেন, “গণতন্ত্র মানে বহুদলীয় গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এই নির্বাচনটা বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন। না হলে গণতন্ত্র হয় না।”

“এই প্রেক্ষিতে এ দেশের মানুষ পরাজিত হল। কারণ আবারও একটা বিতর্কিত নির্বাচন হল। এখন লেজিটিমেসি ক্রাইসিস তৈরি হবে। এই নির্বাচন নিয়ে, কমিশনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে”, বলছিলেন মি. মজুমদার।

“ফলে আলাপ আলোচনা করে , সংলাপ করে যে সমস্যাগুলো আছে চিহ্নিত করে যৌথভাবে সমাধান করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ তৈরি করতে পারব। বিভাজনের রাজনীতির পরিণতি কিন্তু কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়”, আরও জানাচ্ছেন তিনি।

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে এবারের ভোট বর্জন করে। এ দাবিতে অসহযোগ কর্মসূচিও ঘোষণা করে দলটি।

এই কর্মসূচিতে সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল না দিতে আহবান জানায় দলটি। একই সাথে নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা না দিতেও নির্দেশনা দেয়া হয়।

গত ২৮শে অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর থেকে চার দফায় ৫ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ করেছে বিএনপি।

এর মধ্যে ভোট বর্জনে অসহযোগের ডাক দিয়ে দ্বিতীয় দফায় গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের কর্মসূচি দেয় দলটি।

২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনও বর্জন করেছিল বিএনপি। নির্বাচন কমিশন জানায় সে নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব দল অংশ নিলেও বড় ধরনের বিতর্ক ছিল সে নির্বাচন নিয়ে।

এসএইচ-০১/০৮/২৪ (অনলাইন ডেস্ক, বিবিসি)