এতগুলো মানুষকে উদ্ধারের গল্পটি শোনালেন সেই নায়ক

এতগুলো মানুষকে

রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে হতাহতের ঘটনায় শোকে মুহ্যমান সারাদেশ। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের প্রচণ্ড চেষ্টা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সবাইকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি।

গতকাল বিকেলের দিক থেকেই ফেসবুকে বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। তার মধ্যে একটি ছিল এক তরুণীকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনার চিত্র। সে ছবিটাতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসের এক যোদ্ধার পিঠের ওপর এক তরুণী। ছবিতেই স্পষ্ট- কতটা কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখে ফিরলেন এই তরুণী। বেঁচে গেছেন তা নিশ্চিত হলেও ফেলে আসা আতঙ্ক তখনও তার শরীরে লেপ্টে আছে। ভয়ার্ত মুখে কাঁদছেন, ছবিতে সে শব্দ শোনা না গেলেও নাম না জানা ওই তরুণীর ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে ছবিটা জুড়ে। তাকে টেনে নিয়ে আসছেন যে ব্যক্তি তার অভিব্যক্তিও হৃদয় ছুয়ে যাচ্ছে, শিহরিত করছে মানুষকে।

শুক্রবার জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয়েছে অগ্নিযোদ্ধা সেই নায়কের সঙ্গে। তিনি হলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) খন্দকার আবদুল জলিল।

আব্দুল জলিল ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলেও আগুনের ভয়াবহতা দেখে তাকে ছুটে যেতে হয় মানুষকে উদ্ধারে।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, টেলিভিশনে যখন দেখলাম আগুনের ভয়াবহতা এবং এখানে অনেক মানুষের জীবনের বিষয়…তখন আমরা মুভ করলাম ঘটনাস্থলের দিকে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা আগুন নেভানোর পাশাপাশি উদ্ধার কাজও চালিয়ে যাব।

আব্দুল জলিল বলেন, তখন তিনটি ল্যাডার ইউনিট দিয়ে আগুন নেভানো হচ্ছিল এবং আরেকটিতে আমি এবং আরেকজন ছিলাম। ওই ল্যাডার ইউনিটে নিয়ে যখন ১২ বা ১৩ তলায় পৌঁছালাম তখন একটি মেয়ে বাঁচান বাঁচান বলে কাঁদছিল। আমরা তাকে কিছুটা আগাতে বলি সে জানায় সে হাঁটতে পারবে না, তার পায়ে আঘাত রয়েছে। সেই সঙ্গে মেয়েটা ভয়েও ছিল। সে শুধু একটা কথাই বলছিল আমার মা নিচে আছে, মায়ের কাছে যাব।

এরপর ওই তরুণীকে নিজের কাঁধে তুলে নেন আব্দুল জলিল। এ সময় সে খুব কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে হালকা করার জন্য জিজ্ঞাসা করি, কী করেন? সে জানায় চাকরি করেন। এরপর তার বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে সে বলে আমার মা নিচেই আছে।

আব্দুল জলিল বলেন, মেয়েটি বাসায় চলে যেতে চাইলে আমি তাকে বলি প্রথমে হাসপাতালে যান, পরে বাসায় যাবেন।

ওই তরুণীকে উদ্ধারের স্থিরচিত্রটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার কারণে, আপনিও এখন ভাইরাল, মানুষের নায়ক- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষের জীবন রক্ষা করে আমরা তৃপ্তি পাই। এ ঘটনাও আমাকে তৃপ্ত করেছে। কিন্তু কেউ যদি মারা না যেত তাহলে আর কোনো অতৃপ্তি থাকতো না।

কেউ যদি মারা না যেত- আব্দুল জলিলের মতোই সারা দেশের মানুষও তাই চেয়েছিলেন, কিন্তু হয়নি। তবে যেই তরুণী বেঁচে ফিরেছেন আগুনে পোড়া ভবন থেকে আব্দুল জলিলের কাঁধে চেপে, এক হাত দূর থেকে দেখে এসেছেন মৃত্যুকে, খুব কাছ থেকে শুনে এসেছেন মৃত্যুর ডাক, তিনি জানেন আব্দুল জলিলের সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও তার কী পূরণ হয়েছে।

মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চেয়ারেই বসেছিলেন পঙ্গু মঞ্জুর

‘আমিতো বের হতে পারছি না। পঙ্গু মানুষ। আমি মনে হয় আর বাঁচব না। সবাই অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি কোনো উপায় না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে আছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করিস। তোরা ভালো থাকিস।’

জীবনের শেষ সময়ে ছোট ভাই মেহফুজ জুবায়ের পলাশের সঙ্গে ফোনে কথাগুলো বলেন মঞ্জুর হাসান (৫০)। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় দুপুর আড়াইটার দিকে ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় মঞ্জুর হাসানের। তার বাড়ি সদর উপজেলার বোয়ালিয়া পূর্বপাড়া গ্রামে। তিনি মৃত মুনছুর রহমানের ছেলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।

নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মঞ্জুর হাসান ছাত্রজীবন থেকে ঢাকায় থাকতেন। ছাত্রজীবন শেষে চাকরি শুরু করেন। এরপর সংসার। পরিবার নিয়ে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে বসবাস করতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে।

কাশেম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকুরি করতেন। ঘটনার দিন মঞ্জুর হাসান ভবনের ২১তলায় কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থায় করছিলেন। আগুন থেকে বাঁচতে সবাই যখন ছোটাছুটি করছিলেন তিনি কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসেছিলেন। আর জীবনের শেষ সময়টুকু স্বজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন।

কিন্তু এক সময় ফোনে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। বার বার রিং হলেও অপর প্রান্ত থেকে আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

শুক্রবার সকালে নিহতের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় গ্রামের লোকজন মঞ্জুর হাসানের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। নিহতের পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। তবে গত কয়েকদিন থেকে নিহতের ছোট ভাই শিমুল বাড়িতে আছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে ভাইয়ের মৃত্যুর কথা জানতে পান তিনি। বাড়িতে কেউ নাই। শুধু গ্রামের লোকজন মঞ্জুরের মরদেহ দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন।

নিহতের ছোট ভাই শিমুল বলেন, চাকরিরত অবস্থায় ২০০০ সালে অফিসের সামনের রাস্তায় ভাই এক সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান। এরপর থেকে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারতেন না। একপ্রকার পঙ্গু জীবন যাপন করতেন। কিন্তু তারপরও কোম্পানি ভাইকে চাকরি থেকে বাদ দেয়নি। অফিসে যখন আগুন লাগে সবাই বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছিল। কিন্তু ভাই পঙ্গু হওয়ায় কিছু করার উপায় ছিল না। অফিসে বসেই ফোনে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

তার শেষ কথা ছিল ‘আমি তো বের হতে পারছি না, এখানে হয়ত আমার শেষ সময় যাবে।’ এক সময় তার ফোনের সংযোগ কেটে যায়। এরপর ফোনে রিং হলেও রিসিভ হয়নি।

গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে শেষ কথা হয় স্বজনদের সঙ্গে। উদ্ধার কর্মীরা তার মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সেখানে তাকে শনাক্ত করা হয়। নিহতের মরদেহ নওগাঁয় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।

নিহতের চাচাতো ভাই সাবেক সেনা সদস্য ফজলুর রহমান বলেন, যখন ঢাকায় থাকতাম নিয়মিত তার সঙ্গে দেখা করতাম। তার অফিসে যেতাম। তাকে ধরে ওঠা-বসাতে করাতে হতো। যখন আগুন লাগার সংবাদ পেলাম তখনই ধারণা করেছি হয়ত সে আর বের হতে পারবে না।

আরএম-১৬/২৯/০৩ (অনলাইন ডেস্ক)