সব প্রচেষ্টায় ব্যর্থ ডেঙ্গু প্রতিরোধে!

ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নির্মূল, নিয়ন্ত্রণ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গৃহীত সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। কিছুতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমছে না। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালগুলোতে বেড খালি নেই। বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে নাভিশ্বাস উঠছে চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিদিন ডেঙ্গু জ্বর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শত শত মানুষ ছুটে আসছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার অজানা ভয় কাজ করছে। প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা, সবার অভিন্ন প্রশ্ন- ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে কবে?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ১ হাজার ৭১২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। গত ১ জুলাই সারাদেশের হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭১ জন। সে তুলনায় আজ ১ আগস্ট ভর্তিকৃত রোগের সংখ্যা বেড়েছে দশ গুণ।

শুধু সরকারি হিসাবেই চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ হাজার ৫১৩ জন রোগী। জানুয়ারিতে ৩৭, ফেব্রুয়ারি ১৯, মার্চ ১৭, এপ্রিল ৫৮, মে ১৯৩, জুন ১৭৬৩, জুলাই ১৫৬১৪ ও আগস্ট মাসের একদিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৭১২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে সরকারি হিসাবে মৃত্যু ১০ জন বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে বলে জোর দাবি রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ইতোমধ্যেই চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টায় ১৩ হাজার ৬৬১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৫ হাজার ৮৩৮ জন রোগী।

এই প্রতিবেদক একাধিক রোগ তত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপকালে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে কেন-এমন প্রশ্ন করলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশা নির্মূল, দমন, লার্ভা ধ্বংস ও জনসচেতনতায় গৃহীত সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।

এডিস মশা দমনের গুরুদায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। তাদের কর্মীরা এডিস মশা নিধন ওষুধ স্প্রে করবে এবং যে সকল স্থানে এডিস মশার প্রজননস্থল রয়েছে সেগুলো খুঁজে বের করে স্প্রে করে লার্ভা ধ্বংস করবে। সিটি কর্পোরেশন ছাড়াও নাগরিকরা সচেতন হয়ে নিজেরা ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল অর্থাৎ বাড়ির আশপাশে ডাবের খোসা, আইসক্রিমের কৌটা, ভাঙা বালতি, ফুলের টব, টায়ার ও টিউবসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা স্বচ্ছ পানি পরিষ্কার করতে পারে। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে এডিস মশা যেন অন্য কাউকে কামড়ে আক্রান্ত করতে না পারে সেজন্য ডেঙ্গু জ্বরের রোগীকে সবসময় মশারির নিচে রাখতে হবে।

কিন্তু প্রতিরোধে অত্যাবশ্যক এ তিনটি কার্যক্রমের কোনোটিতেই সফলতা আসছে না। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশন ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। একইভাবে পারিবারিক বা ব্যক্তি পর্যায়ে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশনকে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মশার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, মশা নিধন কর্মকর্তাদের কার্যক্রম মনিটরিং, জনগণকে সচেতন করে তোলাসহ সর্বোপরি আক্রান্ত রোগীকে মশারির নিচে রেখে নিবিড় পরিচর্যা প্রদান করলে তবেই মশার উপদ্রব কমবে।

তিনি বলেন,একজন ব্যক্তিকে ডেঙ্গু মশা কামড়ালে তা প্রকাশ পেতে পেতে ২-৭ দিন লাগতে পারে, এটাকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলা হয়।

গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ভর্তি ১ হাজার ৭১২ জন রোগীর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২২ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৮১, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২৫, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৯৬, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৪৩, বারডেম হাসপাতালে ৩২, বিএসএমএমইউতে ৩০, পুলিশ হাসপাতাল রাজার বাগে ৩৯, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮৬, বিজিবি হাসপাতাল পিলখানায় ৮, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৪৩ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৮৭ জন।

এ ছাড়া ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৬২জন। ঢাকা বিভাগে ১৪৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৪, খুলনা বিভাগে ৭৬, রংপুর বিভাগে ৩৩, রাজশাহী বিভাগে ৫৮, বরিশাল বিভাগে ৬৩, সিলেট বিভাগে ৩১ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৬২ জন ভর্তি হন।

বিএ-১৩/০১-০৮ (ন্যাশনাল ডেস্ক)