এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের নির্বাচন, বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবক

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা প্রায়ই বক্তব্য দিয়ে থাকেন। দেশের রাজনীতি নিয়েও কথা বলেন তারা। সম্প্রতি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ নানা ইস্যুতে সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৫ এপ্রিল প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টিগ্রেটেড কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজি বাংলাদেশ’ শীর্ষক ডকুমেন্টে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গণতান্ত্রিক সংস্কারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজির ‘চিফ অব মিশন প্রায়োরিটিস’ অংশে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন বলে দেবে বাংলাদেশ বৃহত্তর গণতান্ত্রিক নাকি বৃহত্তর স্বৈরতান্ত্রিক দেশের দিকে অগ্রসর হবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে এবং এর ধর্মনিরপেক্ষ, সহনশীল ও বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হবে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা তাদের কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজির অংশ। পিটার হাস তার দেশের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র (কখনোই) সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেয় না। বাংলাদেশের জনগণের সমৃদ্ধির জন্য আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে—এমন আশা করে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দেশের অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক সংঘাতহীন নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সহিংসতা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় বাধা। ইদানীং রাজপথে সহিংসতা দেখা যাচ্ছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সব পক্ষের দায়িত্ব রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এ মাথাব্যথার প্রতিক্রিয়ায় গত ৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে আপনাদের এত মাথাব্যথা কেন? আগে নিজেদের দেশের অবস্থা দেখুন; তারপর বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলুন।

এ ছাড়া কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বিশ্বের কোনো দেশেরই হস্তক্ষেপ চায় না আওয়ামী লীগ সরকার।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছাড়াও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন। গত ৪ অক্টোবর তিনি বলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি। বাংলাদেশের যে সংবিধান রয়েছে তার আলোকেই সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব। তার আগের দিন ৩ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, বাংলাদেশে যেন সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়। রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে হামলা ও বাধার ঘটনা তারা দেখতে চান না।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্যিক বিচারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশি পণ্য রফতানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য এই যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগও রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পে তারা ঋণ দিয়ে থাকে। সে কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়, যা অপ্রত্যাশিত।

শুধু নির্বাচন নয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ সরব দেখা গেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ নিয়ে ওই স্ট্র্যাটেজি পেপারে বলা হয়েছে, জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নাগরিক স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধের মতো মানবাধিকার বিষয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তৎপর থাকবে। একইসঙ্গে মানবপাচার প্রতিরোধেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা জানিয়েছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যণীয় তৎপরতা কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ মিত্র দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীরব থাকার অভিযোগ রয়েছে। যেমন মিশরে সামরিক একনায়ক সিসির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্কে সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে নির্মমভাবে হত্যার প্রমাণ সৌদি গোয়েন্দার বিরুদ্ধে পাওয়া গেলেও তা এখন ভু‌লে গে‌ছে যুক্তরাষ্ট্র।

শুধু তাই নয়, নিজ ভূখণ্ডে প্রতিবছর হাজারেরও বেশি মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে গুলি করে হত্যা করে মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের দেয়া তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নাগরিকদের মৃত্যুর ঘটনার অর্ধেকই ওঠে না সরকারি রেকর্ডে। ১৯৮০-২০১৮ সালের মধ্যে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ৫৫ শতাংশ ঘটনার রেকর্ড নেই সরকারি নথিপত্রে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে যখন ব্যর্থ হয় তখনই নির্বাচন, মানবাধিকার ও সুশাসনের বুলি আওড়ানো শুরু করে। অর্থাৎ একটি দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা এসব বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকেননি। গত ১০ অক্টোবর ‘চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলতে চায়?’—এই শিরোনামে সময় সংবাদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নানা কারণেই বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশকে ইন্দো প্যাসিফিক জোটে যোগদানে রাজি করানো। যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ কোয়াডে অথবা কোয়াড প্লাসের মতো সামরিক জোটে যোগ দিক।

যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে নয়, চীনের উইঘুর মুসলিম, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এসব বিষয় এখন অভ্যন্তরীণ থাকছে না। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির কারণে বিশ্বে শান্তি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে তার প্রতিবাদ জানানো হয়। এমনকী একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মহলের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে।

এসএইচ-১৫/১৫/২২ (ন্যাশনাল ডেস্ক)