‘আমি-ডামির রাজনীতিতে ভোটের খেলা হচ্ছে, নির্বাচন হচ্ছে না’

বিএনপিকে ছাড়া আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ২০১৪ সালের ‘ভোটারবিহীন ভোটের সম্প্রসারিত মডেল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন একটি সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তারা। তারা বলেছেন, আমি-ডামির রাজনীতিতে এখন ভোটের খেলা হচ্ছে। নির্বাচন হচ্ছে না।

বক্তাদের ভাষ্য, নির্বাচনে অনিশ্চয়তা থাকার কথা। কিন্তু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এজন্যই আসন ভাগাভাগি হচ্ছে। সমঝোতা হচ্ছে। এর পরিণতি শুভ হবে না। সুশাসন, অর্থনীতি, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে করুণ চিত্র এখন দেখা যাচ্ছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।

লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-সাংবাদিকদের ব্যানারে শনিবার ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘ভোট ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

সংলাপে অংশ নিয়ে দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, বিভিন্ন সময় অতীতে যে ভোটগুলো হয়েছে তাতে ভোট ও সংগ্রাম দুটোই আমাদের ইতিহাসে পাশাপাশি চলেছে। ১৯৩৭, ৪৬, ৫৪ ও ৭০ সালের ভোটের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই ভোট নিয়ে অনেক কথাবার্তা ছিল। কোথাও কোথাও হয়তো কারচুপির অভিযোগ ছিল। কিন্তু কেউ ভোট প্রত্যাখ্যান করেনি। সেগুলো গ্রহণযোগ্য ছিল।

‘কিন্তু স্বাধীন দেশে আমাদের যে ভোটপ্রক্রিয়া শুরু করেছি তাতে ভোট এর মর্যাদা হারিয়েছে। এবং এই ভোটের মধ্য দিয়ে জনরায় প্রতিফলিত হচ্ছে না।’

এই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘ভোট হচ্ছে গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ। এবং এই ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার ও বিরোধীদলের অবস্থান নির্ণীত হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি গত দুটো ভোট অর্থাৎ ২০১৪ ও ১৮ সালের ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার ও বিরোধীদলের অবস্থান নির্ণীত হয়নি। সেগুলো ভাগাভাগির ভোট, সাজানো ভোট, নীল নকশার ভোট।

‘এ অবস্থায় আমরা মনে করি দেশে আইনের শাসন, সর্বস্তরে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটা গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক ভোট দরকার।’

সংলাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসে সেই দলই ইলেকশনকে পলিউট করার চেষ্টা করে। যেকোনো ভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো এত অত্যাচার নির্যাতন কেউ করে নাই।

তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকারের আমলে যে আন্দোলনগুলো হয়েছে, তাতে বিরোধীদলের যত লোক মারা গেছে তার সঙ্গে আগের কোনো আন্দোলনের তুলনা করা যাবে না।

‘সবাই ক্ষমতায় থাকার জন্য অনেক গোয়ার্তুমি করে, চালাকি করার চেষ্টা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো এমন নির্মম নির্যাতন, এত মরিয়াভাবে, এত উদ্ধতভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা অতীতে কেউ করে নাই।’

এই অধ্যাপকের ভাষ্য, ‘আমরা অনেকে বলি বিএনপি তো কিছু করতে পারল না। বিএনপি তো আন্দোলন সফল করতে পারল না। এটা সত্য। সবচেয়ে বড় সত্য হলো বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ভুয়া নির্বাচন ঠেকাতে পারছে না। সিপিবি পারছে না। বাসদ পারছে না। আপনি পারছেন না। আমি পারছি না। এখানে আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। আর এই ভুয়া নির্বাচন যারা প্রতিষ্ঠা করছে তারা জিতে আসছে।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘এখানে একজনই নির্ধারণ করছেন—আমি প্রার্থী কে, ডামি প্রার্থী কে। উনিও এটাও নির্ধারণ করছেন, জোটসঙ্গীর প্রার্থী কে হবে, জাতীয় পার্টিকে কতগুলো আসনে ছাড় দেওয়া হবে। ওনার অনিচ্ছায় একটা আসন থেকেও কেউ জিতে আসতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের টাকায় গড়া প্রতিষ্ঠান, আমাদের টাকায় গড়া পুলিশ, প্রশাসন আমাদের ভোট দিতে দেবে না। এমন একটা ব্যবস্থা আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। এখানে বিচার বিভাগকেও ব্যবহার করা হয়েছে।’

ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসার জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাষ্ট্রে আগুন লেগেছে। আপনারা ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চ থেকে আন্দোলন করছেন। আপনারা মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন। যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের সংবিধান বিশ্বাস করেন তাহলে অবশ্যই মানুষের ভোটাধিকারকে আপনার সম্মান করতে হবে। মানুষের ভোটের যদি আপনার অত্যন্ত অপ্রিয় লোকটিও ক্ষমতায় আসে তাহলেও আপনাকে ভোটাধিকারের কথা বলতে হবে। আমাদের এই অনৈক্য কিছুটা হলেও এ সরকারকে হেল্প করছে।’

সংলাপে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের সম্প্রসারিত মডেল হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচনে যেহেতু প্রধান বিরোধী দল নেই তাই ভোটাধিকার, ভোটার, উপস্থিতি এ সমস্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ২০১৮ সালেও প্রশ্ন উঠেছিল। তাই এবারের মডেলে যেটা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে সেটা হলো ভোটারদের উপস্থিত করতে হবে। ২০১৪ সালের সঙ্গে এটা যোগ হচ্ছে। এবং ভোটারদের উপস্থিত করার জন্য স্বতন্ত্র, ডামি প্রার্থী, নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলা তৈরি করা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে, কে ভোট দিতে যাচ্ছে না। আগে ছিল, যে ভোট দিতে যাবে তার মার খাওয়ার মতো অবস্থা হবে।’

বাংলাদেশের এমন একটি ‘ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা অব্যাহত থাকার কারণে’ আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে নেই বলেও মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ তো কখনোই গণতন্ত্র পায়নি আসলে। সবসময়ই নির্বাচিত হোক, সামরিক হোক এক ধরনের স্বৈরতন্ত্রের ভেতরেই ছিলাম আমরা। কিন্তু এই শাসনের সময় এই স্বৈরতন্ত্রটা ফ্যাসিবাদে রূপান্তর হয়েছে। ফ্যাসিবাদ তখনই হয় যখন স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে একটা সম্মতির অবস্থা তৈরি হয়। জনগণের একটা অংশকে যখন তার অংশীদার হিসেবে পরিণত করতে পারে। এটা খুবই বিপজ্জনক।’

আনু মুহাম্মদ মনে করেন, ‘আমরা যে একটা পরাজয়ের মধ্যে আছে এই উপলব্ধিটা খুব বেশি দরকার। যাতে আমাদের সেই প্রস্তুতিটা থাকে।’

নারীনেত্রী শিরীন হক বলেন, ‘দেশের সার্বিক যে চিত্র আমরা এখন দেখছি, ৭ জানুয়ারির পর তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। আমাদের অসহায়ত্ব আরও বাড়বে।’

সংলাপে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ভোটের ট্রেন ট্রাকে উঠে গিয়েছে। আমাদের সরকার এতে চেপে বসেছে। কিন্তু এর গন্তব্য কোথায়? আমি মনে করি একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। এর মূল কারণ হলো এটা হলো একটা ভোটাভুটির খেলা। এটা কোনো নির্বাচন হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পছন্দ করি আর না করি, আমাদের এখানে দুটো ব্র্যান্ড। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। যখন বিএনপি ভোটে থাকে না তখন আওয়ামী লীগ প্রায় সবগুলো আসনেই জিতবে এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ জন্যই তো ভাগাভাগি হচ্ছে। সমঝোতা হচ্ছে। আসন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

‘এটা পাতানো, পূর্ব নির্ধারিত। এখানে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনে অনিশ্চয়তা থাকে। এর পরিণতি অশুভ। এ কারণে আমরা একটা গুরুতর সংকটের দিকে যেতে পারি।’

এদিকে রাশিয়ার ২০২১ সালের নির্বাচনের সঙ্গে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের তুলনা টানেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরোধীদলগুলোকে যেভাবে দমন করা হচ্ছে পুতিনও একই কায়দায় সেখানকার বিরোধী দলগুলোকে দমন করেছেন।

‘সামনে রাশিয়ার নির্বাচন আছে। এবং সেখানকার এক বিরোধীদলীয় নেতার তিন আইনজীবীকে সন্ত্রাস দমন আইনে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুতিন রাশিয়াকে ডেমোক্রেসির নাম নিয়ে যে জায়গায় উপস্থিত করেছেন তা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন কিছু না। বাংলাদেশও ওই পথেই চলছে।’

এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আমরা জানি আমাদের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে দিল্লিতে। এটা খুবই আশঙ্কাজনক। একটা রাষ্ট্র কোন অবস্থায় পৌঁছালে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয় যে ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশের সার্বভৌমত্বকেও স্যাক্রিফাইস করা যায়!’

তাই ৭ জানুয়ারি পর ‘যে সংকটটা তৈরি হতে যাচ্ছে’ সেটা শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপি কিংবা ভোট দিয়ে না বুঝে এর সঙ্গে কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও বোঝার তাগিদ দেন তিনি। সেইসঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যার যার অবস্থানে থেকে নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণের কথাও বলেন তিনি।

সংলাপে আরও বক্তব্য দেন নারীনেত্রী সীমা দত্ত, লেখক-সাংবাদিক সাইদিয়া গুলরুখ, প্রগতি লেখক সংঘের সহসভাপতি শামসুজ্জামান হীরা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আর রাজী, চিত্রশিল্পী আব্দুল হালিম চঞ্চল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রমুখ।

এসএইচ-০৩/২৩/২৩ (ন্যাশনাল ডেস্ক)