রাজশাহীতে পাগলকে মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে কারাগারে পাঠাল পুলিশ

প্রায় পাঁচ বছর ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন গোলাম মর্তুজা (২৯)। গত ছয় মাস ধরে বদ্ধ উন্মাদ তিনি। নাওয়া-খাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ঠিক নেই তার। ঘরে ফেরারও তাড়া নেই তার। তাকে হেরোইন বিক্রেতা সাজিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে রাজপাড়া থানা পুলিশ।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ওই দিন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে নগরীর লক্ষ্মীপুর মোড় যাত্রী ছাউনি থেকে তাকে আটক করে টহল পুলিশের একটি দল। পুলিশের ওই টহল দলটির নেতৃত্বে ছিলেন থানার এসআই (নিরস্ত্র) মাসুদ রানা।

জানা গেছে, ২০১১ সালে ২২ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর ঝাউতলা এলাকার এক চিকিৎসককে জিম্মি করে এক লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন এসআই মাসুদ রানাসহ আট পুলিশ সদস্য। পরে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। প্রত্যেকেই সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। অভিযোগ রয়েছে ওই চিকিৎসককে ম্যানেজ করে অভিযোগ থেকে মুক্তিপান তারা।

বিষয়টি স্বীকারও করেছেন এসআই মাসুদ রানা। তার দাবি, তিনি ওই কাণ্ডে যুক্ত ছিলেন না। অন্যদের কারণে তিনি ফেঁসে গিয়েছিলেন। পরে চিকিৎসক তাকে চিনতে না পারায় দায় থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তবে এই পাগলকে আটকে তার কোনো উদ্দেশ্য নেই বলে দাবি করেন।

এসআই মাসুদ রানার জানান, গোলাম মর্তুজার লুঙ্গির ডান কোচ হতে এক লাখ ১০ হাজার টাকা মূল্যের ১১ গ্রাম হেরোইন পাওয়া গেছে। উপস্থিত লোকজনের সামনেই তা উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের সামনেই সঙ্গে থাকা ডিজিটাল মেশিনে জব্দকৃত মাদক মাপা হয়। ঘটনাস্থলেই জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করেন তিনিসহ দুই সাক্ষী।

এই ঘটনায় ওই দিনই রাজপাড়া থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন এসআই মাসুদ রানা। মামলায় সাক্ষী করা হয় নগরীর আলীগঞ্জ মধ্যপাড়া এলাকার আসলাম আলীর ছেলে রাহাদুজ্জামান (২৩) ও লক্ষ্মীপুর বাকির মোড়ের আয়নাল ইসলামের ছেলে সুমন (৩১)।

লক্ষ্মীপুর মোড়ের পুলিশের বক্সের পাশেই পান-সিগারেটের দোকান রয়েছে রাহাদুজ্জামান ও সুমনের। এদের মধ্যে রাহাদুজ্জামান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ইলেট্রিশিয়ান। সকাল ৯টার আগে তারা দোকান খোলেন না। ওই দিন এতো সকালে সেখানে তারা কি করছিলেন এনিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ।

সাক্ষী সুমনের কাছে সেদিনের ঘটনা জানতে চাইলে তিনি জরুরি কাজের কথা বলে পাশের পুলিশ বক্সে চলে যান। মিনিট পাঁচেক পর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে জানান, পুলিশকে তিনি ওই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন। নিয়ে যাওয়ার সময় ওই ব্যক্তিকে তার পাগল মনে হয়েছিল। তিনি ওই ব্যক্তির কাছ থেকে মাদক উদ্ধার করতেও দেখেননি। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় এসআই মাসুদ রানা এসে তার নাম ঠিকানা নিয়ে যান।

একই ভাষ্য মামলার অপর সাক্ষী রাহাদুজ্জামানেরও। তিনি জানান, পুলিশের কথামত তারা সাক্ষী হয়েছেন। পুলিশ কীভাবে এজাহার সাজিয়েছে সেটিও তারা জানেন না।

ভুক্তভোগী গোলাম মর্তুজা নগরীর কর্ণহার থানার ধর্মহাটা মালিগাছা এলাকার মোক্তার হোসেনের ছেলে। কর্ণহার থানায় গিয়ে তার বিরুদ্ধে মাদকাসক্তি কিংবা মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। উন্মাদ এই যুকককে মাদক ব্যবসায়ী সাজানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী।

গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী তাজরুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পাগল। এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ান। তার দোকানে এসে কেক-কলা-বিস্কুট যা ইচ্ছে নিয়ে যান। হাত থেকে সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ টান দিয়ে নিয়ে যান। ডাকলে ঘুরেও তাকান না। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় জড়ানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন।

গোলাম মর্তুজার বাড়ির পাশেই পবা উপজেলার হুজরিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য তুরজেমা বেগমের বাবার বাড়ি। তিনি বলেন, ছেলেটি দীর্ঘদিন ধরেই পাগল। ছেলের চিন্তায় তার মাও পাগল হয়ে গেছেন। মা-ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে পুরো পরিবার। গোলাম মর্তুজা নন বরং কারা এলাকায় মাদক বিক্রেতা বা সেবনকারী আমরা জানি। সেটি পুলিশও জানে।

হুজরিপাড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম মুজাহিদ বলেন, আমি তার পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। দীর্ঘদিন ধরেই গোলাম মর্তুজা পাগল। প্রায় সময় ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকে। বাবা-মা যত্নে রাখলে বাড়িতে থাকে, তা না হলে বেরিয়ে পড়েন। তিনি কীভাবে হেরোইন পেলেন?

এনিয়ে পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হুজরিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ওই যুবক মানসিক বিকারগ্রস্থ। যে কারণে তিনি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। পুলিশের উচিৎ ছিল তাকে গ্রেফতার দেখানোর আগে ভালোভাবে যাচাই করা। কিন্তু পুলিশ সেটি না করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে ফাঁসিয়েছে।

চেয়ারম্যান জানান, প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে তিনি পুলিশকে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু নিরাপরাধ কাউকে পুলিশ ফাঁসালে তা মেনে নেবেন না। তাকে ছাড়িয়ে আনতে তিনিও চেষ্টা চালাচ্ছেন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে গোলাম মর্তুজা মেজো। বড় ভাই লুৎফর রহমান লিটন চার্জার রিকশা চালান। ছোট ভাই আবু রায়হান কোরআনের হাফেজ। তিনি নগরীর একটি মাদরাসার শিক্ষক। একমাত্র বোন মেলিজা খাতুনের বিয়ে হয়ে গেছে।

গোলাম মর্তুজার বাড়িতে গিয়ে পাওয়া গেলো না কোনো পুরুষ সদস্যকে। নারীরা জানালেন- বাড়ির পুরুষরা গোলাম মর্তুজার সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গেছেন। সেখানে কথা হয় গোলাম মর্তুজার মা অজুফা বেগমের সঙ্গে। কথাবার্তায় ফুটে উঠলো তার মানসিক অবস্থা। ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার আকুতি জানান তিনি।

সাক্ষাৎ শেষে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হলে কথা হয় গোলাম মর্তুজার বড় ভাই লুৎফর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, বাবা দীর্ঘদিন ধরেই হৃদরোগী। চারবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। এরই মাঝে মেজো ভাই পাগল হয়ে যায়। ভাইয়ের চিন্তায় মানসিক ভারসাম্য হারান মা। মা ও ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে কৃষক বাবা নিজের চিকিৎসা করাতে পারেননি। এই ঘটনায় বাকরুদ্ধ তার বাবা। এখন কথা বলতে পারছেন না। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তিনি এই ঘটনায় ন্যায় বিচার চান।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের যমুনা সেল-১ এর বন্দি গোলাম মর্তুজা। সেখানে গিয়েও থামেনি তার পাগলামী। কারারক্ষীরা নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, কয়েক দিন ধরেই তিনি সময়মত খাবার নেননি। আবার যখন খাবার চেয়েছেন তখন পাননি। এমনকি স্বজনরা দেখা করতে গিয়েও তাকে সাড়া দেননি। চার ঘণ্টা কারাগারজুড়ে তল্লাশি করে তাকে বের করে আনা হয়। কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।

এবিষয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন বলেন, তিনি যে পাগল তা তারা কারাগারকে জানানো হয়নি। ফলে সাধারণ বন্দিদের মতই সুবিধা পাচ্ছিলেন তিনি। বিয়ষটি জানার পর তার চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে কারা কর্তৃপক্ষ।

মামলার তদন্তভার পেয়েছেন রাজপাড়া থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) তসলিমা খাতুন। তার এক আত্মীয়র বাড়ি ধর্মহাটা এলাকায়। মামলার নথিপত্র পেয়ে তিনি ফোন করে সেই আত্মীয়ের মাধ্যমে আসামির ঠিকানা যাচাই করেছেন। কিন্তু তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেননি। মামলা তদন্তকালে এমন কিছু পেলে প্রতিবেদনে সেটিই তিনি উল্লেখ করবেন।

সাক্ষ্য সংক্রান্ত কাজে থানার বাইরে আছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন। এ বিষয়ে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদি হাসান বলেন, মাদকাসক্তি থেকে অনেকেই ভারসাম্যহীন হয়ে যান। এমনটি তার ক্ষেত্রেও হয়ে থাকতে পারে। অভিযানে তার কাছ থেকে মাদক পাওয়া গেছে। ফলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।

জানতে চাইলে নগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, এফআইআর অনুযায়ী তার অধিকারে মাদক পেয়ে অপারেশন টিম মামলা করেছে। পাগললকে গ্রেফতারে পুলিশের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে পাগল গ্রেফতার করলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, অনেকেই পাগল ছদ্মবেশ ধরে মাদক ব্যবসা করেন। আবার তাকে পাগল পেয়ে কেউ এই কাজে ব্যবহার করতে পারেন। আবার তাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা হতে পারবে। এটি প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয়। তাছাড়া আদালতে পাগলের প্রমাণাদি উপস্থাপন করলে তিনি আইনি সহায়তা পাবেন।

বিএ-০২/০৩-০৩ (নিজস্ব প্রতিবেদক)