শিক্ষক হৃদয় মন্ডল যা বললেন

‘আমি আবার ক্লাসে ফিরব। আমরা যেহেতু শিক্ষক, ক্ষমাই আমাদের ধর্ম। শিক্ষার্থীরা যাই করুক, আমাকে ওদের ক্ষমা করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে।’

১৯ দিন জেলে থাকার পর জামিনে বের হয়ে সংবাদমাধ্যমকে কথাগুলো বলছিলেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল।

তার ছেলে স্কুলে যেতে পারেনি। সেখানে তাকে কটূক্তি করা হতো। হৃদয় মণ্ডলের পুরো পরিবার দিন কাটাচ্ছে ভয়ের মধ্যে, নিরাপত্তাহীনতায়।

তবে হৃদয় মণ্ডল হেরে যাওয়া মানুষ নন।

ঘটনার শুরু হয়েছিল কীভাবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২ বছর করোনার প্রভাবে স্কুল বন্ধ ছিল। স্কুল খোলার পর প্রথম বা দ্বিতীয় ক্লাস হবে সেটা। সেদিন চিরাচরিত নিয়মেই ক্লাস নিচ্ছিলাম।’

‘বিকেল ৩টার দিকে বিজ্ঞান ক্লাস নিতে যাই। সেখানে বিজ্ঞান সম্পর্কে যতই কথা বলি, শিক্ষার্থীরা আমাকে টানে ধর্মের বিষয়ে কথা বলতে। যতই থামাতে যাই, তারা আমাকে একই প্রশ্ন বারবার করতে থাকে। আমি যতবার শেষ করতে চাই তারা আবারও ধর্মের জায়গায় ফেরত আসে। এভাবে এমন অবস্থা তৈরি করে যে এক পর্যায়ে আমি বের হয়ে চলে আসি।’

এ ধরনের পরিস্থিতি এর আগেও তৈরি হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার শিক্ষকতার ২১ বছরের মধ্যে এমন কোনোদিন হয়নি। সেদিনই প্রথম হয়েছে। ক্লাসে মোবাইল নেওয়া নিষিদ্ধ হলেও, তারা সেদিন নিয়ে গিয়েছিল। আমি সেটা জানতাম না। পরে বুঝতে পারি তারা পরিকল্পিতভাবে মোবাইল রেখেছিল। এটা ২০ তারিখের ঘটনা। পরের দিন ক্লাসে গেলাম, সব স্বাভাবিক ছিল।’

‘এরপর ২২ তারিখ ক্লাস নিয়ে বাসায় চলে গেছি। তখন আমার এক কলিগ ফোন দিয়ে বললেন, স্যার একটু স্কুলে আসেন, কথা আছে। গিয়ে দেখি ম্যানেজিং কমিটির একজন সদস্য, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, আর আমাকে যিনি কল করেছিলেন সেই শিক্ষক বসে আছেন।’

‘আমি জানতে চাইলাম কী হয়েছে। তারা বললেন, স্যার আপনি নাকি ধর্ম নিয়ে এই কথা বলেছেন। তারা তখন এমন কিছু কথা আমাকে বললেন, যেগুলো আমি বলিনি। তখন তাদের বলি, এই কথা তো আমি বলিনি। তারা বললেন, যদি না বলে থাকেন তাহলে এটা কীভাবে হলো। আমি তখন বলি, তাহলে ছেলেদের ডাকেন।’

‘পরের দিন ১১টার দিকে আমাকে যেতে বলা হয়। হেডস্যার আমাকে বললেন, এখানে সমস্যা হতে পারে, আপনি ১১টার আগে স্কুলে আসবেন না। আমি তাকে বলি, ঠিক আছে। আপনার ফোন পেলে আমি আসব।’

‘পরের দিন কয়েকজন এসে আমার বাড়ির দরজায় লাথি দিতে শুরু করে। তারা শিক্ষার্থী নাকি বাইরের কেউ, তা জানি না। তারা এমন অবস্থা তৈরি করেছিল যে আমার বাচ্চাটা কান্না শুরু করে দেয়। আমি ফোনে আমার সহকর্মীদের সব জানালাম। পরে আমি স্কুলে গেলে আমাকে সাময়িক বরখাস্তের চিঠি দেওয়া হয়।’

‘অভিযোগে যেগুলো বলা হয়েছে, সেগুলো আমি বলিনি। এর ৫ মিনিট পরেই চারদিক থেকে এমন আক্রমণ হলো, সব মিলিয়ে বিভীষিকাময় অবস্থা হয়ে গেল। পারে তো আমাকে তারা মেরে ফেলে।’

এর আগের একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার পাশ দিয়ে ৪টা ছেলে যাচ্ছিল, চারপাশে আর কেউ ছিল না। তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিলো, স্পষ্ট শুনলাম। তাদের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে একটি দোকান পর্যন্ত গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে গালি দিলে কেন? তারা বলে, না স্যার আপনাকে গালি দেইনি। পরে আমার এক সহকর্মীকে সব বলি। তিনি ওই ছেলেদের জেরা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিষয়টি স্বীকার করলে, তাদের ধমক-টমক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপরে তারাই ২০ এপ্রিলের ঘটনাটি ঘটায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর আগেও আমার ঘরে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। আমার সহকর্মী, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সেগুলো দেখিয়েছি।’

তিনি জানান শুধু তার সঙ্গেই নয়, এই স্কুলের প্রয়াত শিক্ষক দীপেন দাশ এবং সাবেক ইংরেজি শিক্ষক সামাদ স্যারের সঙ্গেও এ ধরনের আচরণ করেছে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের এমন আচরণের কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টেস্ট পরীক্ষায় পাশ না করলে তারা এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে না। ২, ৪ বা শূন্য পাওয়া শিক্ষার্থীকে তো আমি টেস্টে পাশ করিয়ে দিতে পারি না। ১২০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে এমন কয়েকজন থাকতেই পারে। আরও কয়েকজন আছে যারা স্কুলে না এসে আমাকে ফোন করে বলে, আমি যেন তাদের হাজিরা দিয়ে দেই।’

‘আমার দোষ একটাই, নম্বর পায় না বলে তাদের আমি পাশ করিয়ে দেই না। তাদের আমি বলেছি, খাতায় সঠিক উত্তর না থাকলে আমার দ্বারা তোমাদেরকে পাশ করানো সম্ভব না। যদি সেটা করিও, বোর্ড পরীক্ষায় তো পাশ করবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্কুলে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। স্কুলে দেখা যায়, আমার আলমারির তালা ভেঙে যায়। সবারটা ঠিক থাকে, আমার আলমারির তালা ভাঙা থাকে। হেডস্যারকেও জানিয়েছি।’

এই কাজ স্কুলের বাইরের কারো পক্ষে করা সম্ভব না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুলের কলাপসিবল গেট পার হয়ে বাইরের কারো পক্ষে ভেতরে এসে এই কাজ করা সম্ভব না। তাহলে নিশ্চয়ই স্কুলের শিক্ষকদের ভেতরেই কেউ করেছেন। যেহেতু আমি নিজে কাউকে ধরতে পারিনি, তাই কারো নাম বলতে পারি না।’

আলমারিতে তিনি বেতনের রিসিটের মুড়ি কপিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখেন। তবে, সেগুলো সেখান থেকে হারিয়ে যেত।

হৃদয় মণ্ডল বলেন, ‘এরপর থেকে আমি মুড়িগুলো নিজের কাছে রাখি।’

স্কুলে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ওপর যেদিন হামলা হলো সেদিনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কতজন মানুষ সেখানে হামলা করেছিল সেটা আমি দেখিনি, রুমের ভেতরে ছিলাম। তাদের চিৎকারের শব্দ শুনছিলাম। পরবর্তীতে পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়। পুলিশ যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেখান থেকে বের করেছে, সেটা না করলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। রুম থেকে বের হয়ে দেখতে পাই বড় বড় লাঠি নিয়েও অনেকে সেখানে ছিলেন। পুলিশ আমাকে গাড়িতে তুলে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনও মানুষ আমাকে মারার চেষ্টা করছিল, ইট ছুঁড়ছিল। অনেকে গাড়িতে ওঠারও চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত আমাকে তাড়া করে।’

থানায় নেওয়ার পর পুলিশ সম্মান দেখিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসপি আমার কাছে সব শুনলেন। এরপর তিনি বললেন, নিরাপত্তার জন্য আমার জেলে থাকাই ভালো। আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, সাধারণ একটি মামলা দেওয়া হবে যেন সহজেই আমি জামিন পাই। আমি রাজি হই।’

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের নামে মামলাটি করেন তারই স্কুলের একজন অফিস সহায়ক, যার এই ঘটনার সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না।

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল পুলিশের কথায় মামলার বিষয়ে রাজি হলেও জানতেন না যে, তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯৫ এবং ২৯৫ (ক) ধারায় মামলা করা হয়েছে।

এই ২টি ধারাতেই শাস্তি সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।

দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি, এরূপ অভিপ্রায়ে বা এরূপ অবগতি সহকারে জনগণের যে কোনো শ্রেণির উপাসনালয় বা উক্ত শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক পবিত্র বলে বিবেচিত কোনো বস্তু ধ্বংস, অনিষ্ট বা অপবিত্র করে যে, তদ্বারা জনগণের যে কোনো শ্রেণির ধর্মের প্রতি অবমাননা বলে বিবেচনা করার সম্ভাবনা রয়েছে, সে ব্যক্তি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, যার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’

দণ্ডবিধির ২৯৫/ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি, বাংলাদেশের নাগরিকদের যে কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার অভিপ্রায়ে স্বেচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষাত্মকভাবে কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর সাহায্যে বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তির সাহায্যে উক্ত শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে বা অবমাননা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, সে ব্যক্তি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, যার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, বা জরিমানা বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘আমি তো এর কিছুই করিনি। আমি তো কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাঙচুর করিনি। আমি ছিলাম ক্লাসের মধ্যে।’

তবুও হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তার আইনজীবী আদালতে এটা প্রমাণ করেছেন যে, তিনি ধর্ম অবমাননা করেননি।

‘আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি কথা আছে, ধর্ম ছাড়া যে বিজ্ঞান সেটা হলো পঙ্গু, আর বিজ্ঞান ছাড়া যে ধর্ম সেটা হলো অন্ধ। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। তবে, প্রত্যেককে অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। সমাজে যারা ধর্মান্ধ আছেন তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার বিজ্ঞান,’ বলেন হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল।

এসএইচ-০২/১২/২২ (আঞ্চলিক ডেস্ক, সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার)