স্মার্ট রিকশাচালক : তিন চাকায় ঘুরে জীবন

যে বয়সে দুরন্তপনায় মেতে থাকার কথা সে বয়সেই রিকশাচালক। নিজের পড়ালেখার খরচ সামলিয়ে জোগান দিতে হয় পরিবারেও। বলা হচ্ছে, সিলেটের স্মার্ট রিকশাচালক রিয়াম আহমেদ ফাহিমের কথা। সব প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে সে হতে চায় বড় ইঞ্জিনিয়ার।

সিলেট নগরীতে কলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফাহিম। সিলেট ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র সে। পাঁচ জনের পরিবারে সে ছাড়া রয়েছে বাবা, মা, বড় ভাই ও ছোট এক ভাই।

দীর্ঘদিন ধরে বাবা-মা দুজনই অসুস্থ। তাই পরিবারের দায়িত্ব পড়ে বড় ভাইয়ের ওপর। কিন্তু বড় ভাইয়েরও পরিবার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় ফাহিমের পড়াশোনা। তবে তিন বছর পর বাধ্য হয়ে অদম্য ফাহিম নিজেই নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। শুরু করেন রিকশা চালানো। এতে নিজের পড়াশোনা এবং পরিবার দুটোই সে সামলাচ্ছে এখন।

ফাহিম বলেন, ‘আমি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার বাবা-মা দুজনই খুব অসুস্থ। বাবা কাজ করার মতো সক্ষম না। ফলে ২০১৯ সালের শুরুতে পরিবারের দায়িত্ব নেন আমার বড় ভাই। ভাইয়া একটি হাসপাতালে ছয় হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। কিন্তু সেই বেতনে ভাইয়ার খরচ ও পরিবার চালানো একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ওই বছরই বন্ধ হয়ে যায় আমার পড়ালেখা। আমি তখন সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছিলাম।

‘এরপর প্রায় তিন বছর আমি পড়ালেখা থেকে দূরে থাকি। কিন্তু আমার মধ্যে সবসময় পড়ালেখার তাগিদ কাজ করতো। পড়ালেখা ছাড়ার পর প্রতি মুহূর্তে মনে হতো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিজের জগতটাই অন্ধকার মনে হচ্ছিল। কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো উপায় পাচ্ছিলাম না। এভাবে প্রায় তিন বছর কেটে যায়। ২০২১-এর শেষ দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাকেই কিছু একটা করতে হবে; আমাকে উপার্জনের পথ বের করতে হবে। তখন আমার মাথায় রিকশা চালানোর বিষয়টি আসে।’

ফাহিম বলে, ‘২০২২ সালের শুরুতে একটি বাংলা রিকশা কিনি। সেখান থেকেই আমার উপার্জন শুরু। এরপর ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে আবারও অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। বর্তমানে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ছি।আমি পড়াশোনার খরচ এবং পরিবার দুটোই এখন সামলাতে পারছি।’

সে আরও জানায়, প্রতিদিন স্কুল আর প্রাইভেট মিলিয়ে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা তার চলে যায়। বাকি যে সময় পায় সে সময় রিকশা চালায়।

ফাহিম বলে, ‘আমি মূলত ফজরের নামাজের পর রিকশা নিয়ে বের হই। সকাল ১০টা পর্যন্ত চালাই। ১১টায় স্কুলে যাই; বিকেল ৩টায় আসি। এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে আবার রিকশা নিয়ে বের হই; ৫টা পর্যন্ত চালিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাই এবং ৭টা পর্যন্ত প্রাইভেট পড়ি। এরপর ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত আরও দুই ঘণ্টা রিকশা চালাই। এরপর বাসায় এসে পড়াশোনা করি।’

নিজের আয়-রোজগার নিয়ে খুশি ফাহিম। তার মতে, ‘আলহামদুলিল্লাহ! ভালোই উপার্জন হয়। যা হয় তাতেই আমি খুশি। যেদিন ক্লাস থাকে না ওইদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়। আর স্কুল-প্রাইভেট থাকলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। এ টাকা দিয়ে এখন আমার পড়াশোনা এবং পরিবার দুটোই সুন্দরভাবে চলে।’

সে আরও বলে, ‘আমার রিকশাটা ছিল বাংলা রিকশা, যেটা প্যাডেল চালিয়ে চালাতে হতো। কিন্তু প্যাডেল চেপে রিকশা চালালে আমি অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে যেতাম। এতে ক্লাস করতে কষ্ট হতো, পায়ে ব্যথা করতো। পরে ঋণ নিয়ে মোটর লাগিয়ে ওটাকে অটোরিকশাতে পরিণত করেছি। মোটর লাগিয়েছি, মানে এই না যে, এখন আর কষ্ট হয় না; সব কাজই কষ্টের। তবে আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি, খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এখন আর ততটা কষ্ট লাগে না।’

নিজের কাজ নিয়ে কোনোভাবেই লজ্জায় নেই ফাহিম। সে বলে,‘ আমি রিকশা চালাতে লজ্জা পাই না বরং আত্মতৃপ্তি পাই। কারণ আমি নিজে উপার্জন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাই, পরিবার চালাই। আমার কাছে পৃথিবীর কোনো কাজই ছোট না। কোনো কাজকে ছোট করে দেখতে নেই। কোনো কাজে লজ্জা পেলে তো আর জীবন চলবে না। নিজেকে এগিয়ে নিতে আমি যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত। আমার মতো অনেকে আছে টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারে না। আমি চাই তারাও আমার মতো কিছু করে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাক।’

সে আরও বলে, ‘আমার সহপাঠীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভালো। তারা আমাকে নিয়ে কখনো হাসাহাসি করে না, কখনো ছোটভাবে দেখে না। বরং আমার সহপাঠীরা সবসময় আমাকে সাপোর্ট দেয়। তারাও আমার রিকশায় চলাচল করে। তাদের নিয়ে রিকশা চালাতে আমারও ভালো লাগে।’

বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় ফাহিম। সে বলে, ‘আমি বাবা-মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চাই। আমার বাবা-মায়ের ভালো চিকিৎসা করাতে চাই। আমার ছোট ভাইকেও পড়ালেখা করিয়ে বড় করতে চাই। মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’

জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে তার মতো অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোরও পরিকল্পনা রয়েছে তার। ফাহিম বলে, ‘একসময় ভালো টাকা উপার্জন করতে পারলে অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।’

কোনো প্রতিবন্ধকতা হার মানাতে পারেনি ফাহিমকে। অদম্য ফাহিম যুদ্ধ করে এগিয়ে যাবে তার মূল গন্তব্যে। বদলাবে নিজের ভাগ্য, বদলাবে সমাজ, এ আশাই সবার।

এসএইচ-০৫/০৯/২৩ (আঞ্চলিক ডেস্ক)