নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে

পোশাক খাতে নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি প্রসঙ্গে বিশ্বের নামকরা পোশাক কোম্পানিগুলোর অবস্থান কী? – এমন প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

একটি বিশেষ নিবন্ধে নিউইয়র্ক-ভিত্তিক সংস্থাটি ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া এবং বাংলাদেশসহ পোশাক খাতে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর শ্রমিকদের পরিস্থিতি তুলে ধরেছে।

বিশ্বব্যাপী পোশাক খাতে নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির মাত্রা গুরুতর বলে উল্লেখ করছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

এই প্রতিবেদনে রয়েছে কিভাবে ভারত বা পাকিস্তানে নারী শ্রমিকেরা যৌননিগ্রহের শিকার হয়েও ভয়ে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন না।

কম্বোডিয়ার উদাহরণ দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, দেশটিতে শুধু কারখানাতেই নয়, কর্মকর্তারা কারখানার বাইরেও নারী শ্রমিকদের হয়রানি করে থাকেন।

মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, কর্মকর্তারা নারী শ্রমিকদের পার্টিতে যেতে আমন্ত্রণ জানান, আর তারা না গেলে ভয়ভীতি দেখানো হয়।

এসব দেশে নারী শ্রমিকেরা কোন ভয়ভীতি ছাড়া কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ নিয়ে যাবেন এমন পরিবেশ নেই বলে সংস্থাটি মনে করছে।

এরকম বেশ কিছু উদাহরণও তুলে ধরেছে সংস্থাটি তাদের নিবন্ধে।

বাংলাদেশে পোশাক কারখানার ভবনের নিরাপত্তা, অগ্নি-নিরাপত্তা এবং বেতন ভাতা – এসব নিয়ে বেশ আলাপ-আলোচনা হয়। কাজের পরিবেশ নিয়ে নানা ধরনের শর্তও মানতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো তৈরি পোশাকের উৎস দেশগুলোতে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, পোশাক খাতে নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির বিষয়টি ‘কমপ্লায়ান্স’-এর অংশ হিসেবে কি আরও গুরুত্ব পেতে পারে?

অন্যদিকে, বিশ্বের নামীদামী পোশাক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের মতো দেশের উপর অনেক অনেক শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু নিজেরা তাদের দায়িত্বটুকু কতটা পালন করছেন?

ঢাকার আশেপাশের কয়েকটি কারখানার কয়েকজন পোশাক শ্রমিকের সাথে কথা বলেছিলাম বিষয়টি বুঝতে। তারা খোলামেলা কথা বলেছেন, তবে স্বভাবতই কেউ-ই নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের বক্তব্যে বেশ অনেকটাই মিল পাওয়া গেলো – অর্থাৎ অভিযোগগুলো মোটামুটি একই ধরণের।

ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি কারখানায় কাজ করতেন এমন একজন শ্রমিক বলেছেন, “আমাকে ম্যানেজমেন্টের একজন কু-প্রস্তাব দিছিলো। তার সাথে হোটেলে রাত্রে যাইতে হবে। আমারে বলছে যদি না যাও, তাইলে তোমার চাকরী থাকবে না। আমি নালিশ করছিলাম। আমারেই তারা ফ্যাক্টরি থেকে বের কইরা দিছে।”

আরেকজন শ্রমিক বলেন, “কাজে কোন সমস্যা হইলেই যে ভাষায় কথা বলে, তা আমি মুখে আনতে পারবো না। ওরা প্রায়ই গায়ে হাত দেয়। গালাগালি দেয়া যেন ওদের কাজে অংশ”

এই শ্রমিক শব্দগুলো শেষ পর্যন্ত আমাকে বলেছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম যৌনতা বিষয়ক গালি নারী শ্রমিকদের দেয়া হয় বলেই তিনি জানালেন।

এই নারী শ্রমিকেরা যে অভিযোগগুলো করেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিবন্ধে একই ধরনের বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, প্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্য কোন সংস্থা, যেমন কোন কর্পোরেট অফিসে নারীকর্মীদের সাথে এমন শব্দ ব্যবহার বা আচরণ করার সাহস কেউ করবেন কি-না।

পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মূলত দরিদ্র পরিবারগুলো থেকে আসেন। কাজ চলে গেলে মারাত্মক বিপদে পড়তে হয় – এবং একই সাথে শ্রমকাঠামোতে এসব নারীদের অবস্থানগত কারণেই এমন আচরণ করা হয় বলে শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন।

কারখানার মাঝারি পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই যৌন হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। তবে নারী শ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিকদের দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মৌখিক নোংরা কথাবার্তার অভিযোগ আসে হরহামেশাই।

কয়েকটি এনজিও’র তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম ‘সজাগ কোয়ালিশন’ গেল বছর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো।

চারটি এলাকার আটটি কারখানার শ্রমিকের ওপর করা ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ২২ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন যে তারা কখনো-না-কখনো যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

কমবেশী ৮৩ শতাংশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করেন না।

যৌন হয়রানি হিসেবে কারখানায় প্রবেশের সময় নিরাপত্তা কর্মীদের অস্বস্তিকরভাবে দেহ তল্লাশি, পুরুষ সহকর্মীর অপ্রত্যাশিত স্পর্শ, মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা যৌন সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা, সম্পর্ক তৈরি না করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন – এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

শ্রমিকদের ৬৮ শতাংশ জানান, কর্মক্ষেত্রে তেমন কার্যকর কোন যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি নেই।

এই গবেষণাটির প্রধান ছিলেন মাহিন সুলতান। তিনি বলছেন, “আমরা বলতে চাচ্ছি, একটা ফ্যাক্টরিতে কমপ্লেন আসলে তা যদি সুষ্ঠুভাবে ডিল করা হয়, তা কিন্তু ফ্যাক্টরির জন্য একটা ক্রেডিট, যে সেখানে শ্রমিকরা সাহস করে কমপ্লেন করার পরিবেশ পাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “প্রশাসনের তদন্তের ভিত্তিতে যদি একটা অ্যাকশন নেয়া হয়, তাহলে সবাই বুঝবে যে এই ফ্যাক্টরিতে যে কাঠামো থাকা উচিৎ, যেভাবে কাজ করা উচিৎ, সেটা কাজ করছে।”

বাংলাদেশে ৪০ লক্ষের বেশি পোশাক শ্রমিক রয়েছে, যার ৮০ শতাংশই নারী। তাই তাদের প্রতি আচরণ কতটা সম্মানজনকে হওয়া উচিত, বা একজন শ্রমিক কতটা নিরাপদ বোধ করবেন – এসব কিছুই কি কাজের পরিবেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত?

শ্রমিক নেতৃবৃন্দ মনে করেন, এটি নিশ্চিত করা গেলে তাদের কাজের দক্ষতা আরও বাড়বে।

পোশাক খাতের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর একটি প্ল্যাটফর্ম, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কার্যকরী সভাপতি কাজী রুহুল আমিন জানান, “আমাদের কাছে বিভিন্ন সময় নারী শ্রমিক বোনেরা আসে। কারখানায় নানাভাবে এটা ঘটে। ম্যানেজমেন্ট থেকে যেমন ঘটে তেমনি পুরুষ শ্রমিকদের দ্বারাও ঘটে।”

তিনটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা ব্যাপারটা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র – এদের কাছে সাধারণত রেফার করি।”

কিন্তু শ্রমিকদের সংগঠনগুলো যে কতটা সরাসরি শ্রমিকদের সহায়তা করে সেটি বোঝা মুশকিল, কেননা তারা হয়রানির ঘটনাগুলোর সমন্বিত কোন হিসেব রাখে না।

আমিন বলছেন, “বায়াররাও কোন এমন কোন ঘটনা পেলেই সেটাকে ইস্যু করে বারগেইনিং শুরু করে দেয়। তারা অনেক বেশি লাভ করে কিন্তু কাপড়ের জন্য সেই পরিমাণ মূল্য আমাদের দেয় না।”

মালিকদের পক্ষ অবশ্য নিজেদের লাভ ছাড়া শ্রমিকের ভালোমন্দ নিয়ে কতটা ভাবেন, এমন প্রশ্ন অনেকদিন ধরেই উঠছে।

এনিয়ে কথা বলেছিলাম পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের সাথে। তিনি বলেন, বিজিএমইএর অবস্থান এই ব্যাপারে একদম জিরো টলারেন্স।

“শুধু গুটিকয়েক ফ্যাক্টরির জন্য আমাদের পুরো সেক্টরের বদনাম হবে এবং যার কারণে আমাদের বিজনেসে একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হবে, এটা বিজিএমইএ’র চেয়ারে বসে আমরা একেবারেই দেখতে চাই না।”

তিনি আরও বলেন, “আমরাও মেম্বারশীপের ক্ষেত্রে খুব চুজি হয়ে গেছি। রানা প্লাজার পরে আমরা শুধু সেফটি ইস্যুই দেখি না, আমরা সোশাল ইস্যুও দেখি।”

তিনি বলেন, ফ্যাক্টরিগুলোতে বিদেশি ক্রেতারা তাদের পছন্দমতো শ্রমিকদের বেছে নিয়ে যায় কথা বলার জন্য। সেখানে ম্যানেজমেন্টের কেউ থাকে না। তারা নির্ভয়ে সেখানে সব বলতে পারে।

মাহমুদ হাসান খান বলেন, শ্রমিকদের উচিত মুখ খোলা।

কিন্তু যে পোশাক শ্রমিক চাকুরী চলে যাওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে পারে না, তার জন্য ন্যায়বিচার কিভাবে নিশ্চিত হবে? কিংবা সেজন্য একটি সঠিক ব্যবস্থা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়?

এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে একটা মেকানিজম আছে। তবে সেটাকে আরও হেলদি করতে হবে।”

“যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তিনি যদি সামনে এগিয়ে না আসেন, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। আর চাকরীর কথা বলছেন? দক্ষ শ্রমিকের চাকরীর কোন সমস্যা নাই,” বলছেন মাহমুদ হাসান খান।

এসএইচ-১৯/১৩/১৯ (শাহনাজ পারভীন, বিবিসি)