অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকার ৪১৬ হাসপাতাল-ক্লিনিক

রাজধানীসহ ঢাকার ৪২৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে ঝুঁকিতে রয়েছে ৪১৬টি। এর মধ্যে ১০৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩১১টি ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিঝুঁকি এড়াতে জলাধার, ভবনের ধারণ সক্ষমতা, হিট ডিটেক্টর, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফটসহ যেসব বিষয় থাকা বাঞ্ছনীয় তা অধিকাংশ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেই।

অগ্নিঝুঁকির ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ব্যবস্থাপনা রয়েছে মাত্র সাতটি হাসপাতাল-ক্লিনিকে।

২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ৪২৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন শেষে এমনই প্রতিবেদন দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা হাসপাতালগুলোতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্নিঝুঁকি হ্রাসে কিছু পরামর্শও দেয়া হয়। কিন্তু সেসব পরামর্শের কোনোটিই আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ঘটে যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও সোহরাওয়ার্দীর মতো অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৭ মে ঢামেকে অগ্নিকাণ্ডের পর সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কোনো ধরনের হতাহত ছাড়া আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ‘ওয়েক আপ কল’ বা ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

যদিও ২০১৭ সালে রাজধানীসহ ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো জরিপ করে অগ্নিঝুঁকির ওই সতর্কবার্তা জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দফতর।

ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ঢাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে সব ধরনের স্থাপনা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয় ফায়ার সার্ভিস। শুরুতে ঢাকার ৪৩৩টি হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং বছর শেষে ৪২৩টি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিদর্শন করা হয়।

পরিদর্শনে মাটির নিচের জলাধারের ধারণ ক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্থতা, স্মোক/হিট ডিটেক্টর, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে ঝুঁকি নিরূপণ করা হয়।

২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন করে ৪৩৩টির মধ্যে ১৭৩টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৪৯টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। তবে মাত্র ১১টি হাসপাতাল-ক্লিনিককে অগ্নিনিরাপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

ওই একই বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ৪২৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন শেষে ১০৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩১১টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস। ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে মাত্র সাতটিকে সন্তোষজনক হিসেবে দেখানো হয়।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘ঢাকাসহ সারাদেশের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো পরিদর্শন করে ঝুঁকি নিরূপণ করা হয়। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়। হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করার জন্য লিখিতভাবে অন্তত তিন দফা মন্ত্রণালয়েও সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কার্যত খুব বিশেষ অগ্রগতির তথ্য আমরা পাইনি।’

‘কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাদের হালনাগাদ তথ্যও জানায়নি। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না- আমাদের জানা নেই।’

২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত পরিদর্শন প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার মধ্যে রয়েছে- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল।

তালিকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয় তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতালকে।

সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও সতর্ক করা হয় তখন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালই সংস্থাটির এ সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি। বাস্তবায়ন করেনি তাদের সুপারিশও।

ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিঝুঁকিতে থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে— শমরিতা হাসপাতাল, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার-২, ক্রিসেন্ট গ্যাস্ট্রোলিভার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, ধানমন্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতাল, ধানমন্ডি কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বিএসওএইচ হাসপাতাল, প্যানোরমা হসপিটাল লিমিটেড, ধানমন্ডি মেডি এইড জেনারেল হাসপাতাল লি. ও মেরিস্টোপ বাংলাদেশ।

অগ্নিঝুঁকির তালিকা অনুযায়ী, বারিধারা ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন ২০টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে অ্যাপোলো ও ইউনাইটেড হাসপাতালের অবস্থা সন্তোষজনক। তবে পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ বাকি ১৩টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ।

সিদ্দিকবাজার ও সদরঘাট ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন ২৫টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে সবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মিরপুর, ভাষানটেক এলাকার ৩৮টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে পাঁচটি সন্তোষজনক, বাকিগুলোর মধ্যে সাতটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৬টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

ডেমরা পোস্তগোলা এলাকার ৬৬টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে সন্তোষজনক মাত্র একটি, বাকিগুলোর মধ্যে ৫৮টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও সাতটি ঝুঁকিপূর্ণ। তেজগাঁওয়ের ১৯টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে সন্তোষজনক নেই একটিও, ১৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও চারটি ঝুঁকিপূর্ণ।

উত্তরার ২৭টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে চারটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাকি সবই ঝুঁকিপূর্ণ। কুর্মিটোলা এলাকার ছয়টিই ঝুঁকিপূর্ণ। মোহাম্মদপুর এলাকার ৭৪টির মধ্যে ছয়টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাকি সবই ঝুঁকিপূর্ণ। খিলগাঁও-ডেমরার ৩৫টির মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ১৮টি, ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ।

লালবাগ, পলাশী ও হাজারীবাগ এলাকার ৩৫টির মধ্যে সবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ডিইপিজেড ও সাভার এলাকার ৮৭টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে সন্তোষজনক মাত্র তিনটি, অতি ঝুঁকিতে রয়েছে ৫৩টি এবং ৩১টি ঝুঁকিপূর্ণ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনু বিভাগ) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শন প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ, অতি ঝুঁকিপূর্ণসহ কয়েকটি ভাগ ছিল। এর আলোকে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে বিষয়টি জানিয়েছি। কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না- তা জানা নেই।’

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ও বুয়েট-জাপান ইন্সটিটিউট অব ডিজাস্টার প্রিভেনশন অ্যান্ড আরবান সেফটি (বুয়েট-জিডপাস)-এর ডিরেক্টর ড. রাকিব আহসান বলেন, ‘আগুন লাগলে কী প্রিপারেশন (প্রস্তুতি) থাকা দরকার সে সম্পর্কে অধিকাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের ধারণা নেই। আগুন লাগার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইলেক্ট্রিক শর্ট সার্কিট ও দাহ্যপদার্থ থেকে যেমন- ব্রয়লার বিস্ফোরণ। হাসপাতালের ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রিক শর্ট সার্কিট বেশি হয়। প্রত্যেকটি হাসপাতালে ফায়ার সার্ভিস অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন), ইলেক্ট্রিক অ্যাসেসমেন্ট খুবই জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু হইচই করি তখনই যখন ভবন ধসে পড়ে কিংবা আগুন লেগে যায়। বড় ক্যাজুয়ালটি ছাড়া যেন আমাদের টনকই নড়ে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সিভিল সোসাইটির উচিত প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করা।’

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত শুক্রবার বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুনের ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। আমরা সব হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখব। এছাড়া হাসপাতালগুলোর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও তার ঠিক আছে কি না- তাও খতিয়ে দেখা হবে।

আরএম-১০/১৯/০২ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: জাগোনিউজ)