কেমন চলছে রাজশাহীতে নারী সাংবাদিকতা

নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা, পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, উল্লেখযোগ্য হারে সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ার কারনে সাংবাদিকতা পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ হাতে গোনা। বিশেষ করে মফস্বল শহরে এই ধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশায় তাদের উপস্থিতি শূন্যতায় বিরাজ করছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তবে তারা আশার কথা বলছেন সময়ের ধারাবাহিকতায় এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় নারীরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। যদিও পরিসংখ্যানগত ভাবে তা কম। এর পরেও নানা প্রতিকুল পরিস্থিতিকে তালুবন্দি করেই রাজশাহীর সংবাদমাধ্যমগুলোতে নারী সাংবাদিকের উপস্থিতি ঘটছে। তবে কখনও কখনও কেবল পরিচর্যার অভাবে ঝরেও পড়ছে।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে রাজশাহীতে সংবাদ মাধ্যমে নারীদের অংশ গ্রহণ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ শুরু হয় ২০০২ সালে। গণযোগাযোগ বিষয়ক জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র সেন্টার ফর কমিউনিকেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট-সিসিডি বাংলাদেশ রাজশাহীতে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে নারীদের সাংবাদিকতা পেশায় সমপৃক্ত করার প্রয়াস চালায়। সফলতা বড় পরিসরে না হলেও শূন্যতা ছিল না। ঢাকাসহ রাজশাহীতে বেশ কয়েকজন মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেন। তাদের দু’ একজন এখনও এ পেশার সাথে রয়েছেন।

তবে পরিচর্যার অভাব ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি না হবার কারনে পদ্মা পাড়ের এই শহরে নারী সাংবাদিকতা কলেবরে বৃদ্ধি পায়নি। এই নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অভিমত স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আর্থিক দৈন্যতা আর গতানুগতিক সমাজ ব্যবস্থা সাংবাদিকতার মত চ্যালেঞ্জিং পেশায় সম্পৃক্ত হতে পারছেন না। অনেকের ইচ্ছা থাকলেও কখনও কখনও পরিবারও বড় বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। যার কারনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীসহ অন্যান্য পেশায় দিন দিন নারীর সম্পৃক্তা হু হু করে বাড়লেও সংবাদ মধ্যমে নজরকাড়ার মত উপস্থিতি নেই।

ঢাকায় মাঠ পর্যায়ে ও গণমাধ্যম অফিসগুলোতে যেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় রাজশাহীর মত জেলা শহরগুলোতে তা নেই। তবে এই শিক্ষানগরীতে সেই ২০০২ সাল থেকে নারী সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু থেকে কখনই শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। আসা যাওয়ার মধ্যে নারী সাংবাদিকতা টিকে রয়েছে এবং তারা কাজ করছেন মাঠ পর্যায়ে। এদের মধ্যে অনেকে রাজশাহী শহরে সাংবাদিকতা শুরু করে এখন ঢাকাতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতেও সক্ষম হয়েছে।

উল্লেখ করার মত লাখমিনা জেসমিন সোমা, মাফিয়া মুক্তা, রাখি জেসমিন, সাদিয়া আফরোজ। আর এদের পথ ধরেই নানা প্রতিকুলতাকে মোকাবিলা করে রাজশাহী মহানগরীতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন রওনক আর জেসমিন ও শিরিন সুলতানা কেয়া। একজন দৈনিক সোনালী সংবাদ ও অনলাইন পোর্টাল সাহেববাজার ডটকম এবং অপর জন দৈনিক সোনার দেশ ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বর্তমান পত্রিকায় কাজ করছেন।

নারী দিবস উপলক্ষে দুজনকেই দেখা যায় নারীদের বিভিন্ন অধিকার সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে সংবাদ সংগ্রহের জন্য কাজ করছেন। বিশেষ করে সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের অধিকার কতটুকু সফলতার আলোর মুখ দেখেছে এমন বিষয় নিয়ে তারা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলছেন দেশের একাধিকবার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজে। কথা হয় দুজনের সাথে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ি বছর দুয়েক থেকে তারা মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকতার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন।

রওনক আরা জেসমিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইনে লেখাপড়া শেষ করে দীর্ঘদিন ঢাকায় থেকে ফিরে আসেন। রংতুলি ছেড়ে হাতে তুলে নেন কলম আর প্যাড। অনেকটা কর্মের সন্ধানে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত উত্তরা প্রতিদিন পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষনে অংশ নিয়ে এই পেশার জন্য নিজেকে তৈরী করেছেন। তাঁর মুল পথ চলা শুরু হয় স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত দৈনিক সোনার দেশ পত্রিকায়। সেখানে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পশোগত দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি বলেন, সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জিং হলেও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এ পেশাটির প্রধান বাধা নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা। দিনের বেলায় তেমন সমস্যা না হলেও রাতের বেলায় কোন ধরনের বিপদ হলে আত্মরক্ষার জন্য তেমন কিছু নেই। শুধু তাই নয় সেই ধরনের কোন প্রত্যাক্ষ ঘটনার নিউজ কভারেজ করতে গিয়েও নানান বিপদের সম্মুক্ষিন হবার সম্ভাবনা থাকে। সে ক্ষেত্রেও আত্মরক্ষার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে করা হয় না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কালিন কমবেশী প্রতিদিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তেমন একটা সমস্যা হয়নি। তবে রাতের বেলায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় যানবাহনের সমস্যা হয়। এর ব্যবস্থা হওয়ার দরকার প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে। এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে নারীরা আগ্রহী হবেন সাংবাদিকতা পেশায়।

জেসমিন বলেন, নারী হবার কারনে কখনও কখনও সুনির্দিষ্ট রিপোর্টের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সরকারি, বেসরকারি অফিসে কিছুটা বিড়ম্বনার সম্মুক্ষিন হতে হয়। তথ্য পাবার জন্য একাধিকবার যেতে হয়।

নারী সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে তিনি বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা রয়েছে। তবে তার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। পরিবারের সদস্যা জেনেছেন পেশায় অন্তর্ভূক্তির দুই মাস পর। তাঁকে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কোন ধরনের সমস্যা ফিল না করলে তিনি এই পেশা চালিতে যেতে পারবেন।

তবে এর উল্টটা ঘটেছে দৈনকি সোনালী সংবাদ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল সাহেববাজার ডট কমের স্টাফ রিপোর্টার শিরিন সুলতানা কেয়ার সাথে। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মষ্টিার্সের শিক্ষার্থী। প্রায় এক বছরের অধিক সময় সাংবাদিকতার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন।

তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে কোনভাবেই সাংবাদিকতার সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর জন্য ইতিবাচক সাড়া পাননি। কিন্ত পরবর্তীতে সংবাদপত্রে নাম দিয়ে এক এক করে সংবাদ প্রকাশ হতে থাকলে বাবা-মা কিছুটা নমনিয় হন। তাছাড়াও যেহতু এ বিষয়ে লেখাপড়া করছি ফলে এই পেশায় থাকলে সে ক্ষেত্রটি আরো সহজ হবে এমনটা ভেবেই তারা সাংবাদিকতা করার অনুমতি দিয়েছেন।

কেয়া বলেন, টিভিতে সংবাদ উপস্থাপনা দেখে শখের বসেই সাংবাদিকতা পেশায় নিজেকে জড়িয়েছেন। তবে এখন আর শখের মধ্যে সিমাবদ্ধ নেই। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আগামীতে তিনি সাংবাদিকতা পেশাতে থাকতে চান।

দৈনিক রাজশাহী সংবাদের সম্পাদক আহসান হাবীব অপু বলেন, নানা সিমাবদ্ধতার কারনে রাজশাহীতে নারী সাংবাদিকতা ক্ষেত্রটি এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে কাজ হয় অধিক রাত পর্যন্ত। আর নারীদের অধিক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা পরিবারের সদস্যরা বা সমাজব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনা। এই পরিস্থিতিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে নারী সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত হবে বলে তিনি মনে করেন।

গণযোগাযোগ বিষয়ক জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র সেন্টার ফর কমিউনিকেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট-সিসিডি বাংলাদেশ এর যুগ্ম-পরিচালক সাহানা পারভিন বলেন, রাজশাহীতে নারী সাংবাদিকতার প্রসার না ঘটার অন্যতম প্রধান বাধা কর্মক্ষেত্রের সুযোগ কম। বর্তমানে এই বিভাগীয় শহর থেকে বেশকিছু পত্রিকা ও অনলাইন প্রকাশ হলেও অর্থনৈতিক অবস্থানটা তেমন ভাল না হবার কারনে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে পারছেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবে যে দু’একজন নারী সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত হবার চেষ্টা করছেন তারা সুযোগ পাচ্ছেন না। তাছাড়াও দীর্ঘদিন থেকে সমাজ ও পরিবারের গতানুগতিক নিয়মের বেড়াজালে নারীরা সাংবাদিকতার মত চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিজেদের জড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, সিসিডি নারী সাংবাদিক তৈরীর জন্য বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে অংশ গ্রহণ অধিক হলেও পেশাগত জড়ানোর পরিসংখ্যান খুব বেশী নয়। তবে এ পর্যন্ত যে কয়জন এই পেশার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন তারা ঢাকায় সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আগামীতে আবারো নারী সাংবাদিক তৈরীর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবার পরিকল্পনা রয়েছে সিসিডির বলে জানান তিনি।

এসএইচ-০২/০৮/১৯ (সুমন হাসান)