ইমরান খানের বাংলাদেশ সফর ছিল ব্যতিক্রমী

উনিশশো উননব্বই সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর ইমরান খান যখন ঢাকা সফরে আসেন তখন ক্রিকেট দুনিয়ায় তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।

বাংলাদেশে তখনো ক্রিকেট জনপ্রিয় খেলা হয়ে উঠেনি। ফুটবল তখনো দেশের এক নম্বর খেলা। কিন্তু তারপরেও ক্রিকেটার ইমরান খানের নাম গ্রাম অবধি ছড়িয়েছে।

ইমরান খানের সে সফরটি ছিল বেশ সাড়া জাগানো। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর বাংলাদেশ সফরের পর ইমরান খানের সেই সফরটি ছিল বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের বড় কোন তারকার সফর।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ-এর ক্রীড়া বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে তিনি ঢাকা সফর করেন।

ছয়টি রোগ – যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও এবং হাম – থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য যে টিকাদান কর্মসূচী ছিল। টিকাদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ইমরান খান ছয়দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন।

এর আগে ১৯৭৯ এবং ১৯৮৪ সালে দুইবার ইমরান খান ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালের সেই সফর ছিল ব্যতিক্রম।

ইউনিসেফের বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফরে তিনি ঢাকায় আসেন।

খান তার সে সফরে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। রাজশাহীতেও তার যাবার কথা থাকলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে সেটি বাতিল করতে হয়েছিল।

ঢাকার সংবাদপত্রগুলোতে তখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ইমরান খান। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তাকে নিয়ে প্রতিদিনই একাধিক রিপোর্ট ছাপা হয়।

ইমরান খান কী করছেন, কেমন পোশাক পরেছেন, পোশাকের রং কী, তিনি শেভ করেছেন কিনা, কেন তিনি বিয়ে করছেন না – ইত্যাদি বিষয়ে গণমাধ্যমের নজর ছিল।

ঢাকায় এসে প্রথম দিন এক সংবাদ সম্মেলনে ইমরান খান বলেন, তার জনপ্রিয়তা শিশুদের জন্য কাজে লাগাতে চান।

খান ব্যাখ্যা করেন, কেন তিনি ইউনিসেফের বিশেষ দূত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাকিস্তানের মুলতানে একটি ক্রিকেট ম্যাচে দর্শক গ্যালারিতে বসে থাকা এক শিশু বলের দ্বারা আঘাত পায়।

আহত সে ছেলেকে হাসপাতালে দেখতে যান মি. খান। হাসপাতালের করুণ পরিবেশ দেখে তিনি উপলব্ধি করেন যে উপমহাদেশের শিশুরা কত অসহায়।

আর তখন থেকেই এই অসহায় শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন ইমরান খান।।

“ইউনিসেফ আমাকে তাদের বিশেষ দূত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে যে সম্মান করেছে আমি তা রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো,” বলেন ইমরান খান।

সফরের দ্বিতীয় দিনে ঢাকার মহাখালীতে ইপিআই (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী) ভবনের উদ্বোধন করেন ইমরান খান।

সেখানে তিনি মিথিলা নামে এক শিশুকে পোলিও প্রতিষেধক টিকা খাইয়ে এর উদ্বোধন করেন।

টিকাদান কর্মসূচীতে অংশ নিতে ইমরান খান চট্টগ্রামেও যান।

বিমানবন্দর থেকে তিনি আগ্রাবাদ কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে একটি শিশুকে পোলিও টিকা খাইয়ে ইপিআই কর্মসূচী শুরু করেন। এছাড়া তিনি ইপিআই কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতাও দেন।

সেখানে তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌর কর্পোরেশন ইমরান খানে জন্য একটি নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করে।

বাংলাদেশে ছয়দিন অবস্থানকালে ইমরান খানের সাথে ছিলেন সাংবাদিক আফসান চৌধুরী।

চৌধুরী লিখেছেন শিশুদের টিকা দেবার জন্য উৎসাহ দিতে ইমরান খানকে দিয়ে ‘আপনার শিশুকে টিকা দিন’ বক্তব্য রেকর্ড করানো হয়েছিল। পরবর্তীতে টিকা বিষয়ে সচেতনতার জন্য টেলিভিশনে সেটি বারবার প্রচার করা হয়েছিল।

ইমরান খান আশা করেন ১৯৯০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ইপিআই কর্মসূচী তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে।

বাংলাদেশ সফরের সময় ইমরানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও গণমাধ্যমের আগ্রহের কোন কমতি ছিল না। সাঁইত্রিশ বছর বয়সী মি. খান তখন একদিকে অবিবাহিত, অন্যদিকে তার খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে।

বলিউডের বিভিন্ন নায়িকার সাথে ইমরান খানের প্রেম ও রোমান্স নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা ও আলোচনা ছিল সংবাদমাধ্যমে।

ইমরান খানের বাংলাদেশ সফরের নানা খুঁটিনাটি খবর তুলে ধরেছিল তৎকালীন সংবাদপত্র দৈনিক বাংলা।

পত্রিকাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে ইমরান খানকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, একজন প্রার্থিত পুরুষ হয়েও কেন তিনি বিয়ে করছেন না।

ইমরান খান উত্তর দিয়েছিলেন, “বিয়ের কোন পরিকল্পনা নেই আমার।”

খানের সে সফরের বিস্তারিত রিপোর্ট করেছেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার তৎকালীন সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার (প্রয়াত)। তিনি ইমরান খানের একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন।

দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ” ঘর-সংসারী না হওয়ার পেছনে তেমন কোন কারণ নেই। ব্যাপারটা যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে। আবার আদৌ নাও ঘটতে পারে। তবে আমি বিয়ের বিরোধী নই।”

সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার দৈনিক ইত্তেফাকে লিখেছেন, বাংলাদেশে অবস্থানকালেও ঢাকার সুন্দরীরা তাকে শান্তিতে থাকতে দেননি। তার গ্ল্যামারে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন একটু কথা বলতে। কিন্তু তারা আকৃষ্ট করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি।

ইমরান খানের সেই সফর নিয়ে সাংবাদিক আফসান চৌধুরী ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে ঢাকা কুরিয়ার সাময়িকীতে একটি স্মৃতিচারণা করেছেন।

চৌধুরী লিখেছেন, ঢাকায় ইমরান খান যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন সেখানে একবার এক তরুণী তার সাথে দেখা করতে আসেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায় যে আগের রাত থেকেই সেই তরুণী হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছে। ইমরান খান তখন ঢাকার বাইরে ছিলেন। তিনি হোটেলে ঢুকতেই সেই তরুণী ইমরান খানের সামনে যান।

ইমরান খান তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কী চান? সেই তরুণী বললেন, তার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।

এ পর্যায়ে হোটেলের নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে সরিয়ে নেয়।

তখন ইমরান খান আফসান চৌধুরীকে বলেন, ” সম্ভবত সে আমাকে বিয়ে করতে চায় বা অন্য কিছু।”

ইমরান খান ধরনা করেছিলেন, সে তরুণী হয়তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

ইমরান খান ঢাকায় আসার পর তার ছয়দিনের সফরসূচী তখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

তিনি যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই শতশত মানুষ তাকে দেখার জন্য ভিড় করেছিল।

কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ঢাকার খিলগাঁও এলাকার তিলপাপাড়ার একটি কমিউনিটি সেন্টারে ইপিআই কর্মসূচীতে যাবার কথা ছিল ইমরান খানের। কিন্তু সেদিন জেনারেল এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে হরতালের ডাক দিয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।

হরতালের কারণে ইমরান খানের তিলপাপাড়ার কর্মসূচী বাতিল হয়। কিন্তু তার আগেই মি. খানকে দেখার জন্য শতশত মানুষ ভিড় করে সেই কমিউনিটি সেন্টারের সামনে।

ইমরান খানকে একনজর দূর থেকে দেখা কিংবা তার কাছে দিয়ে একটি অটোগ্রাফ নেবার জন্য উৎসুক ছিলেন অনেকে।

তখন ঢাকা ক্লাবের কর্মকর্তারা একটি ক্রিকেট ব্যাটে ইমরান খানের অটোগ্রাফ নিয়েছিল। তৎকালীন সংবাদপত্র দৈনিক বাংলার খবর অনুযায়ী সেই ব্যাট ইমরান খানের একজন ভক্ত ত্রিশ হাজার টাকায় সে ব্যাট কিনে নিয়েছিলেন।

খান যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই তিনি অটোগ্রাফ শিকারিদের কবলে পড়েছেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বিমানে যাবার সময় বিমানবালাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন মি. খান।

বিমানের সে ফ্লাইটে তৎকালীন দৈনিক বাংলার একজন সাংবাদিক ছিলেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত তার বর্ণনা ছিল এ রকম – ইমরান খান বিমানে উঠে সামনের সারিতে বসে একটি ইংরেজি কাগজ দিয়ে মুখ ঢাকলেন। পাশের আরেকটি সিটে বসেছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী নাজিউর রহমান।

“বিমানের দুই এয়ার হোস্টেস চিনে ফেললেন ইমরানকে। প্রাতঃরাশের প্লেট নিয়ে একজন এগিয়ে গেলেন ইমরানের কাছে। ইমরান জুস খেলেন। কেক ফিরিয়ে দিলেন।”

“কিছুক্ষণের জন্য দেখলাম ইমরানকে নিয়ে দুই এয়ার হোস্টেস ব্যস্ত। চুপিসারে তারা অটোগ্রাফের খাতা তুলে ধরলেন ইমরানের সামনে। ইমরান অটোগ্রাফ দিলেন।”

ইমরান খানকে দেখার জন্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ছিল লোকে লোকারণ্য। তাকে স্বাগত জানাতে এয়ারপোর্ট থেকে শহর অভিমুখে বড় বড় তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল। রাস্তার পাশে ছেলে-মেয়েরা ইমরানের ছবি ও পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ক্রিকেটের মানুষ ইমরান খান সেই সফরে শুধু টিকাদান কর্মসূচী নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না।

এর পাশাপাশি তিনি জাতীয় এবং তরুণ ক্রিকেটারদের সাথে মতবিনিময় করেছেন এবং সংক্ষিপ্ত কোচিং সেশনে অংশ নিয়েছেন।

এসএইচ-০১/০৮/২২ (আকবর হোসেন, বিবিসি)