মানব পাচার রোধে দ্বিতীয় ধাপেই আছে বাংলাদেশ

মানব পাচার রোধে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দ্বিতীয় ধাপেই আছে বাংলাদেশ। এটি বন্ধে উদ্যোগ বাড়লেও, এখনো ঘাটতি রয়েছে বলে জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে।

২০২২ সালের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অভিবাসী প্রেরণকারী দেশ এবং রেমিট্যান্স গ্রহণকারী অষ্টম বৃহত্তম দেশ।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট— টু থাউজেন্ড টুয়েন্টি থ্রী—শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধা স্বল্প থাকায় বাংলাদেশের অভিবাসী প্রত্যাশীর ৯০ শতাংশই নির্ভর করে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর। যারা বিদেশ প্রত্যাশী ওই সব শ্রমিকদের কাছ থেকে উচ্চ ফি নিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগ অভিবাসী মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব, দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো, মালয়েশিয়া, ব্রুনায়,মালদ্বীপ ছাড়াও ইউরোপ ও আমেরিকায় গিয়ে থাকেন। সেখানে বেশিরভাগ নারী, পুরুষ বিশেষ করে শিশুরা মানব প্রাচারকারীদের শোষণের শিকার হয়। বাংলাদেশির এই অভিবাসী প্রত্যাশীরা কম দক্ষ হওয়ায় মানব পাচারকারীরা এই সুযোগ নিয়ে তাদের টার্গেট করে অবৈধ পথে পাঠিয়ে থাকে। ফলে ওই শ্রমিক অভিবাসী প্রত্যাশীরা প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন। ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও শিশুদেরকে যৌন কাজে লিপ্ত করা হয়। সম্প্রতি এর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

এদিকে, ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গাদের দিকে বেশি নজর মানব পাচারকারীদের। বিশেষ করে রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণী ও শিশুরা মানব পাচারে শিকার হচ্ছে। তাদেরকে চাকরি ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নেপাল ও ভারতে যৌনকার্যের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হয়।

ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানবপ্রাচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাল্যবিবাহ এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার, দরিদ্র এবং প্রান্তিক ব্যক্তিরা। এছাড়াও করোনার কারণে যারা চাকরি হারিয়েছেন, মৌসুমি শ্রমিক, স্বল্প শিক্ষিত এবং বেকার যুবক, ছাত্র এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তরা।

এছাড়া ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, মানবপাচার রোধে যা করা প্রয়োজন, তা পুরোপুরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে, উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা গেছে। আইনি মারপ্যাঁচে পাচারকারীদের একটি অংশ পার পেয়ে যাচ্ছে আর এতে পাচার রোধে সরকারের প্রচেষ্টা বাধার মুখে পড়ছে বলেও জানানো হয়েছে এই রিপোর্টে। অবস্থার উন্নতির জন্য আইন ও বিচার বিভাগের দক্ষতা বাড়ানোসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

সরকার বছরের পর বছর ধারাবাহিকভাবে পাচার বিরোধী তথ্য প্রকাশ না করায় দেশে পাচারের পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা এবং ডেটা তুলনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। সরকার যে সময় ২৪০ জন পাচারের শিকার ব্যক্তিকের কথা উল্লেখ্য করা হয় যার মধ্যে ১১৫ জন যৌন পাচারের শিকার, ৯২ জন জোরপূর্বক শ্রমের শিকার এবং ৩৩ জন অন্য কোনো কাজে পাচারের শিকার কথা বলছে, তা পূর্বের চেয়ে অনেক কম। এর আগে যেখানে ১ হাজার ১৩৮ ভুক্তভোগীর কথা বলা হয়েছিল।

পর্যবেক্ষকরা উল্লেখ করেছেন, অপর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের কারণে প্রতিবেদনের সময় সরকার শিকারের প্রকৃত সংখ্যা তুলে ধরতে পারছে না। এর সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি কমপক্ষে ৬ হাজার ৭৮১ জন পাচারের শিকারকে চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে ৯৬১ জন যৌন পাচারের জন্য, ৩ হাজার ৭৬৪ জন শ্রম পাচারের জন্য এবং ২ হাজার ৫৬ জন অন্যান্য কাজে পাচারের শিকার হয়েছে।

মানবপাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে টায়ার-১ সেরা এবং টায়ার-৩ এ থাকা দেশগুলোর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। টায়ার-৩ তালিকায় থাকা দেশগুলোর উন্নয়ন সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশ ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ এই ৩ বছর টায়ার-২লিস্টে ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু কাজ করেছে। যেমন, পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনা, রোহিঙ্গা পাচারের ঘটনার তদন্তে প্রথমবারের মতো গুরুত্বারোপ এবং সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির বিদেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে ফি কমানো হয়েছে।

তব ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে শেল্টারের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো আগের মতোই অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে। পাচারকারীদের বিচারের রায়ে অধিকাংশকে কারাদণ্ডের বদলে জরিমানা করা হচ্ছে।

এসব বিষয় মানবপাচার রোধে সরকারের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসএইচ-১২/১৬/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)