শুরু টোয়েন্টি টোয়েন্টি ফোর, শেষ টোয়েন্টি থ্রি

সৌরজগতের নিখুঁত নিয়মে প্রতিদিন সূর্যোদয় হয়। প্রতিদিনের মতো সোমবারও সূর্য উঠেছে। শীতের কুয়াশা সরিয়ে উঁকি দিয়েছে উজ্জ্বল রোদ। কিন্তু অন্য যে কোনো দিনের চাইতে ভোরের আলোতে যেন বেশি মায়া মাখানো। যেন নতুন স্বপ্নের কথা বলছে। বলছে, সামনের দিনগুলোতে অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে শুভময়তা ছড়িয়ে যাবে দেশে, পৃথিবীময়। আশাজাগানিয়া সূর্যকিরণ যেন সে দ্যুতিই ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রত্যেকের প্রাণে, মনে।

রোববার সূর্যাস্ত শেষে দিবাগত রাতের প্রথম প্রহরেই প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব নিয়ে বিদায় নিল আরও একটি বছর। বিশ্বের বয়স বাড়ল আরও এক বছর। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আর ‘হিংসা, হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা ও যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব’ দেখার প্রত্যাশার ঝাঁপি খুলে সোমবার বিশ্বময় আশাজাগানিয়া যে নতুন সূর্যটি উঠেছে, সেটি নতুন বছরের। বিদায় ঘটনাবহুল ২০২৩, স্বাগত ২০২৪ সাল। হ্যাপি নিউ ইয়ার।

অশুভ শক্তির মিথ্যা বোধ, প্রজন্মের নষ্ট হয়ে যাওয়া মুখগুলোর ‘আস্ফালন’, আর সহিংস রাজনীতির অশুচি কাটিয়ে আজ অস্তাচলে গেল যে সূর্যটি, আজ পূর্বদিগন্তে শাশ্বত সেই সূর্যেরই উদয় হয়েছে নতুন সৌন্দর্যের আবাহন ঘটিয়ে।

নতুন বছরে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের একটি প্রশ্ন থেকেই গেছে। আর তা হলো চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার নির্বাচন বানচালের নামে অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতাকারীদের কী দমন করতে পারবে? দুর্নীতি-সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদমুক্ত শান্তিময় দেশ উপহার দিতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেশবাসীকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এই ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূুর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের ব্যালটের রায়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে দেশ কোন পথে যাবে? আজকের বদলে যাওয়া বাংলাদেশ কী আবারও অন্ধকারের যুগে ধাবিত হবে, না কি লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা ও মহান মুুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে ব্যালটের মাধ্যমে বিজয়ী করে দেশ আরও এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে? নতুন বছরে দেশের মানুষ এসব বিষয়ে নতুন করে শপথে বলীয়ান হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের কৌতূহল, শঙ্কা এবং আলোচনা এখনো তুঙ্গে। জনমনের প্রত্যাশা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার পথ ধরেই।

স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতি বছর পহেলা জানুয়ারি আমাদের মধ্যে আসে। আমরা আলোড়িত হই। আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে আমরা অঙ্গীকার করি, নতুন বছর নতুনভাবে চলতে। নতুনভাবে জীবন-যাপন করতে, নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে। ব্যক্তিচরিত্র বদলেরও অঙ্গীকার করি আমরা। পুরনোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেওয়াই মানুষের সহজাত প্রবণতা। তবে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতি, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বছরটি কেমন গেল, তার হিসাব-নিকাশ সবাই করে থাকেন।

মানুষের সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা ঘটনায় আলোচিত-সমালোচিত ছিল বাঙালি জাতির জন্য ২০২৩ সাল। একদিকে উন্নয়নের নবতর যাত্রায় যোগ হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলসহ আরও বেশকিছু মেগা প্রকল্প। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার জাঁতাকলে পড়ে মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাসের বছরও ছিল বিদায়ী ২০২৩ সাল। এসব মোকাবিলার নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন বছর, ২০২৪ সাল।

অন্যান্য বছরের তুলনায় বিদায়ী বছরটি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেললেও, লক্ষ্যচ্যুত হয়নি বাংলাদেশ। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র নব্য আধিপত্যবাদ মোকাবিলা করেও অব্যাহত রেখেছে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। তবে একই সময় যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দা, ডলার সংকটসহ মজুতদারীর কারণে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। বছর শেষে শঙ্কা কাটিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো বার্তা দিয়েছে অর্থনীতি। রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানো গেলে, সরকার স্থিতিশীল হলে, সমাজের অনৈক্য দূর করা গেলে আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের স্বপ্ন আরও গতি পাবে- এমনটাই মনে করছেন দেশের মানুষ।

তবে যা-ই হোক, কালপরিক্রমায় দ্বারোদ্ঘাটন হলো প্রকৃতির নতুন নিয়মে নতুন বছর ২০২৪-এর। চেতনায় জাগ্রত আবহমান সেই মাঙ্গলিক বোধ-অতীতের জীর্ণতা অতিক্রান্ত দিনমাসপঞ্জির হিসাব থাক বিস্তৃতির কালগর্ভে, প্রত্যাশায় বুক বাঁধি নতুন দিনের সূর্যালোকে- তবে উদ্ভাসন হোক সজীব-সবুজ নতুনতর সেই দিনের- যা মুছে দেবে অপ্রাপ্তির বেদনা; জাগাবে নতুন প্রত্যয়ে নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাবার প্রেরণা।

গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা অনুযায়ী ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন আজ। আজ ২০২৪ সালের প্রথম দিন। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’

বাংলাদেশে ইংরেজি নববর্ষ পালনের ধরন বাংলা নববর্ষ পালনের মতো ব্যাপক না হলেও এ উৎসবের আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া থেকে বাংলাদেশের মানুষও বিচ্ছিন্ন নয়। বিশ্বের বয়স আরও এক বছর বাড়ল। এক বছরের ‘আনন্দ-বেদনা, আশা-নৈরাশ্য আর সাফল্য-ব্যর্থতার পটভূমির ওপর আমাদের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই প্রিয় বাংলাদেশ নতুন বছরে পর্বতদৃঢ় একতায় বিপর্যয়-দুঃসময়কে জয় করবে অজেয়-অমিত শক্তি নিয়ে’- এ সংকল্পের সোনালি দিন আজ। আলোড়ন আর তোলপাড় করা ঘটনাবহুল ২০২৩-এর অনেক ঘটনার রেশ নিয়েই মানুষ এগিয়ে যাবে। ভাগ্যাকাশে আনন্দ-বেদনা প্রত্যাশা আর দুর্যোগের ঘনঘটা নিয়েই বাঙালির বছর ফুরাল। সূচনা হলো আরও একটি বর্ষযাত্রা।

নতুন দিনের নতুন সুর্যালোকে স্নান করে সিক্ত হবে জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। সব কালিমা ধুয়ে-মুছে নতুন কেতন ওড়াতে ওড়াতে এগিয়ে যাবে সময়, সভ্যতা, হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানিমুক্ত রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতি। অনাবিল স্বপ্ন আর করোনামুক্ত পূর্বের মতো সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন আর অফুরন্ত প্রাণোন্মাদনা নিয়ে নতুন সূর্যের আলোয় অগ্রসর হবে মানুষ। বিগত সময়ের সব ভুল শুধরে নেবার সময় এসেছে আজ।

জাতির অনেক আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হবার বছর এটি। বাংলাদেশের মানুষও নতুন প্রত্যাশায় বুক বেঁধে নতুন বছরটি শুরু করেছে। তাই নতুন বছরকে স্বাগত যুদ্ধমুক্ত সুখ-সমৃদ্ধি, উন্নয়ন-অগ্রগতি আর জঙ্গী-সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশায়। খ্রিস্টীয় নববর্ষের প্রথম দিন আজ। প্রাচীন সূর্য রবিবার যে দিবসকে কালস্রোতে বিলীন করে পশ্চিমে অস্ত গেল, তা আজ ফেলে আসা দিন।

প্রতিবছর থার্টি ফার্স্টে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরমানন্দে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। বিশ্বের মানুষ অন্যরকম আনন্দে মেতে ওঠেন নতুন বছরের মাহেন্দ্রক্ষণে। বিশ্বের মানুষ নানা আয়োজনে নতুন বছর ২০২৪-কে বরণ করেছে নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে। এবার উন্নত বিশ্বও নানা ব্যাপকতা নিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছে। রোববার রাত ১২টার পরই সারাবিশ্বে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতায়।

হিসাবের খাতায় ব্যর্থতার গ্লানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে নতুন বছরে শান্তিকামী মানুষের প্রার্থনা ছিল- আর কোনো সহিংসতা নয়, কোনো হত্যা-খুন কিংবা হানাহানির রাজনীতি নয়, ২০২৪ হবে শান্তির বীজ বপনের সাল। যুদ্ধ, অস্ত্র বা হানাহানির মহড়া হবে না, থেমে যাবে সব যুদ্ধ-সন্ত্রাস। সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন বছরের শুরুতেই ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী উন্নত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ উপহার দেবে জাতিকে।

গোধূলি বেলায় রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার মধ্য দিয়ে হারিয়ে গেছে ঘটনাবহুল ২০২৩ সালটি। উদিত হয়েছে নতুন বছরের নতুন সূর্য। প্রত্যাশা কেবল মানুষের উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ, শান্তি, স্বস্তি, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণ, শক্তহাতে জঙ্গি-সন্ত্রাসী দমন এবং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির দেশ গড়ার। এ প্রত্যাশা রেখেই আজ সোমবার থেকে যাত্রা শুরু হলো নতুন বছরের। স্বাগত ২০২৪, বিদায় ২০২৩।

এসএইচ-০১/০১/২৪ (অনলাইন ডেস্ক)