তীব্র শীতে কাবু জনজীবন, ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা

দেশের মুন্সিগঞ্জে সিরাজদিখান উপজেলার কৃষক মো. বিল্লাল হোসেন মোল্লা পাঁচ একর জমিতে আলু, বেগুন, সরিষা, লাল শাক, চিয়া সিডসহ শীতের বিভিন্ন সবজি চাষ করেছেন।

তিনি জানান, কিছুদিন আগে বৃষ্টিতে আলুর বেশ ক্ষতি হয়েছে। এখন আবার তীব্র শীতের কারণে ফসল নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন রয়েছেন।

মোল্লা জানান, “শীতে আলুতে আর কোনও ঝামেলা যাতে না হয় সে জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ স্প্রে করছি নিয়মিত।”

সারা দেশে চলা সপ্তাহব্যাপী তীব্র শীতে নাকাল জনজীবনের পাশাপাশি ফসলের ক্ষতি নিয়েও কিন্তু উদ্বিগ্ন কৃষকরা।

জানুয়ারির এ সময় বোরো ধান, আলু, ডাল, তৈলবীজ জাতীয় ফসলসহ মাঠে রয়েছে শীতকালীন বেশ কিছু ফসল।

নিম্ন তাপমাত্রা ও কুয়াশা-যুক্ত আবহাওয়ার কারণে এসব ফসল বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তাই কৃষি কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে এসব ফসল রক্ষায় বাড়তি যত্ন ও ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

সারা দেশ-ব্যাপী নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মে মাস পর্যন্ত বোরো ধানের মৌসুম চলে।

এ সময় বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। ধানের বয়স ৪০ দিন বা ৪৫ দিন হলে চারা তুলে মাঠে রোপণ করা হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোসাম্মৎ সালমা পারভীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সপ্তাহব্যাপী তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কারণে বীজতলায় থাকা চারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”

“তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রির নিচে চলে গেলে ধানের চারাগাছ হলুদ হয়ে যেতে পারে, তখন তা খাদ্য তৈরি করতে পারবে না। চারা মরে যেতে পারে। চারা যাতে মরে না যায় সেজন্য স্বচ্ছ সাদা পলিথিন দিয়ে বাঁশের মাচার মতো তৈরি করে বীজতলা ঢেকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছি আমরা।”

“তা ছাড়া এই তীব্র শীতের কারণে চারাগাছ যাতে মরে না যায় তাই আরো এক সপ্তাহ পরে বীজতলা থেকে চারা তুলে রোপণ করতেও বলা হচ্ছে”, জানান মিস পারভীন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ফারুক বিন হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাতের তাপমাত্রা যখন ২০ ডিগ্রির নিচে চলে আসে ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার জন্য আর্দ্রতা ৮০ বা ৯০ পারসেন্ট হয়ে যায় তখন শীতকালীন ফসলে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ হয়।”

“এ সময় মূলত আলু, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল চাষ হয়। ঠাণ্ডা ও ভেজা আবহাওয়া এসব ফসলে রোগ বিস্তারের জন্য অনুকূল। তাই ফসল রক্ষায় বাড়তি সতর্কতা নিতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়”, জানান মি. হোসেন।

“এই তীব্র শীতে আলুতে ব্যাপক হারে মড়ক রোগের আক্রমণ হয়। কুয়াশা-যুক্ত আবহাওয়ায় মড়ক রোগে আক্রান্ত আলু গাছ দ্রুত লতাপাতা ও কাণ্ডসহ পচে যায়। দুই-তিনদিনের মধ্যেই মাঠের সমস্ত গাছই মরে যেতে পারে।”

“এছাড়া তাপমাত্রা আরো নেমে গেলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় মসুর ডাল। গোড়া পচা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই রোগের আক্রমণ এড়াতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, নতুবা ব্যাপক ফসল-হানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে” বলছেন মি. হোসেন।

তার পরামর্শ, “মসুর ডালে গোড়া পচা রোগ দমনে অটোস্টির-৫০ ডাব্লিউ পি নামে ওষুধটি প্রতি লিটার পানিতে দশমিক দুই গ্রাম মিশিয়ে সাত থেকে দশদিন পরপর দুই -তিনবার গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।”

এছাড়া “তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি থেকে ১৮ ডিগ্রি ও আর্দ্রতা ৮০ থেকে ৯০ পারসেন্ট হলে সরিষাতে কাণ্ড পচা রোগ দেখা দেয়। এ রকম আবহাওয়ায় যদি এ রোগ দেখা দেয় তাহলে ধ্বংসাত্মক অবস্থা দেখা দেয়।

কাণ্ড পচা রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে প্রতি লিটার পানিতে রোভরাল দুই গ্রাম মিশিয়ে তিনবার ফসলে স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ফারুক বিন হোসেন।

হোসেন জানান, “তীব্র শীত বা শৈত্যপ্রবাহে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি রোধে খুব সাবধান থাকতে হয়। নিয়মিত হারে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিলে অনেক ক্ষতি রোধ করা যায়”।

বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মতলুবার রহমান বলেন, “এ রকম আবহাওয়ায় আলুর মড়ক রোগ এড়াতে কৃষকদের প্রতি লিটার পানিতে তিন গ্রাম হারে ম্যানকোজেব ছত্রাক-নাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি।”

এছাড়া যেসব আলুর বয়স ৬০ দিনের উপরে, সেগুলোর জন্য আলাদা পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

“শৈত্যপ্রবাহের কারণে বীজতলার চারা হলুদ বা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই কৃষকদের বীজতলা রক্ষায় প্রতি শতাংশ জমিতে ২৮০ গ্রাম ইউরিয়া ও জিপসাম ৪০০ গ্রাম দিতে হবে। সম্ভব হলে রাতের বেলা পানি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে। সকালে পানিটা বের করে দিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের”, বলেন মি. রহমান।

তিনি আরও জানান, “যেসব বীজতলার চারার বয়স বেশি হয়ে গেছে সেগুলোর ক্ষতি হবে না। তবে, যেগুলোতে নতুন বপন করা হচ্ছে সেগুলোতে ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা থাকে।”

এছাড়া মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটাসহ শীতকালীন সবজি এখনো মাঠে রয়েছে। তবে এগুলো সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বলে জানান তিনি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রোববার বাংলাদেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো আট দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কক্সবাজারের টেকনাফে ২৭ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গায় যে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলেছে তা আরো থাকবে বলে জানায় আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে, কিছু জায়গায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি পার হতে পারে।

ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করবে, দিনের তাপমাত্রা বাড়বে না আরো দুইদিন। সূর্যের আলো দেখা দেবে না।

ফলে সার্বিকভাবে আগামী দুই দিনে শীতের তীব্র অনুভূতি কমার কোনও সম্ভাবনা নেই বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

তারা আরও জানিয়েছে, ১৬ই জানুয়ারি থেকে রাতের তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে। ১৭ ই জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেঘ দেখা যেতে পারে।

১৮ ও ১৯ শে জানুয়ারি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার রয়েছে।

রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কিছু জায়গায় হালকা অথবা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

ফলে কুয়াশা অনেকখানি কেটে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাতের তাপমাত্রা কিছুটা নেমে গেলেও মানুষের মাঝে তীব্র শীতের যে অস্বস্তিকর অবস্থা তা থাকবে না। কারণ সকালের দিকে সূর্যের দেখা মিললে দিনের তাপমাত্রা বাড়বে।

এসএইচ-০১/১৪/২৪ (অনলাইন ডেস্ক, বিবিসি)