সূর্যর আলো নিভে গেলে যা ঘটবে পৃথিবীতে

সৌরজগতে পৃথিবীর কাছে সূর্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। আলো, তাপ, আবহাওয়াসহ প্রায় সব ধরনের শক্তির যোগান দিয়ে পৃথিবীকে প্রাণিকূলের বাসযোগ্য করে রেখেছে এই নক্ষত্রটি। কিন্তু ভেবে দেখেছেন হঠাৎ করে যদি নক্ষত্রটির মৃত্যু হয় কিংবা বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে সৌরজগতে কী ঘটবে? কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে পৃথিবী? কতদিন সময় পাবে মানুষ, তারপরও বেঁচে থাকবে কি না?

সূর্য

নাসার তথ্যসূত্রে, প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে একটি নীহারিকা (নেবুলা) থেকে আমাদের সৌরজগৎ ও তাকে কেন্দ্র করে সূর্য নামের জ্বলন্ত একটি নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। নীহারিকা ছিল গ্যাস এবং ধূলিকণার একটি বিশাল, ঘূর্ণায়মান মেঘমালা। নেবুলা তত্ত্বের সূত্রমতে, অতিক্রান্ত কোনো তারকা বা সুপারনোভার শক ওয়েভের কারণে নীহারিকার কেন্দ্রে মহাকর্ষীয় পতন ঘটে। পতনের কারণে নীহারিকার বেশিরভাগ উপাদান, বিশেষত গ্যাসসমূহ কেন্দ্রে গিয়ে জমা হয়, সৃষ্টি হয় তীব্র চাপের। আর তা থেকে জন্ম হয় সূর্যসহ এই আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহ-নক্ষত্রের।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফির তথ্যমতে, জ্বলন্ত গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত সূর্যের এই গ্যাসগুলো আসলে প্লাজমা আকারে বিদ্যমান। প্লাজমা হলো গ্যাসের মতো পদার্থের একটি অবস্থা, তবে বেশিরভাগ কণাই আয়নিত। এর অর্থ হচ্ছে, কণাগুলোতে ইলেকট্রনের সংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাস পেয়েছে।

সূর্যের বিভিন্ন অঞ্চল রয়েছে। অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে কোর, বিকিরণ অঞ্চল এবং পরিচলন অঞ্চল। বাহ্যিক দিকে আছে চলমান দৃশ্যমান পৃষ্ঠ বা ফটোস্ফিয়ার, ক্রোমোস্ফিয়ার, ট্রানজিশন জোন এবং তারপরে আছে সূর্যের বিস্তৃত বাইরের বায়ুমণ্ডল, করোনা।

সূর্যের উপাদান

সৌরজগতের প্রায় ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি পদার্থ রয়েছে সূর্যে। নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণের ফলে একত্র হওয়া হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের একটা বিশাল বলই হচ্ছে সূর্য। হাইড্রোজেন হচ্ছে সূর্যের জ্বালানি। সূর্যের মূল অংশ বা কোরে পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়া হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে পরিণত করে। যা থেকে পৃথিবী জীবন ধারণের শক্তি সঞ্চয় করে।

প্রায় ৪৬০ কোটি বছরে সূর্যের প্রায় অর্ধেক জ্বালানি ইতোমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে। বাকি যা আছে তা দিয়ে সাকুল্যে আরও ৪৫০ থেকে ৫৫০ কোটি বছর এই অবস্থায় থাকবে। প্রতিটা নক্ষত্রই তার নির্ধারিত সময়ে বিষ্ফোরিত হবে, সূর্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে।

এরপর, হাইড্রোজেনের অভাবে কার্যপ্রক্রিয়া থেমে যাবে, ক্রমান্বয়ে এই নক্ষত্রটি লাল দানব (রেড জায়ান্ট) নক্ষত্রে পরিণত হবে। এ সময় সূর্যের আকার বর্তমানের চেয়ে কয়েকশত গুণ বেড়ে যাবে। সূর্যের এই বিবর্তন-প্রক্রিয়ার শেষ হলে, ৭০০ কোটি বছর পরে এটি ক্ষুদ্র সাদা বামন (হোয়াইট ডরফ) নক্ষত্রে রূপান্তরিত হবে। এ সময় এটি পৃথিবীর মতো ছোট আকার ধারণ করবে। ধীরে ধীরে সূর্য একটি মৃত নক্ষত্রে পরিণত হবে, পরবর্তী কয়েক শত কোটি বছরের জন্য শীতল হবে। অবশ্য, এর অনেক আগেই পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা।

সুপারনোভা বিস্ফোরণ

১৫ কোটি কিলোমিটার দূরের নক্ষত্রটি থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে মাত্র ৮ মিনিট। আমাদের কাছে এই দূরত্বটা অনেক বেশি মনে হতে পারে। তবে, আগামীকাল যদি সূর্যের কোরে জ্বালানির অভাব দেখা দেয় এবং তা আচমকা একটা সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটায়, তাহলে সুপারনোভার গতির কাছে এই দূরত্ব খুবই সামান্য হয়ে যাবে।

একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে নিরাপদ থাকতে হলে বর্তমান অবস্থান থেকে পৃথিবীকে অন্তত আরও ৫০ থেকে ১০০ আলোকবর্ষ দূরে যেতে হবে। ফোর্বস-এর একটি তথ্যসূত্রে, কোরে বিস্ফোরণের ফলে সূর্যের আয়তন বেড়ে যাবে, প্রচণ্ড তাপে বুধ ও শুক্র গ্রহের পাশাপাশি পৃথিবীও জ্বলে যেতে পারে। তবে, সুখবর হচ্ছে, সূর্য বিস্ফোরিত হলে এর ফলে সৃষ্ট শকওয়েভ পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করার মতো শক্তিশালী হবে না। কেবল সূর্যের দিকে মুখ করা অংশটি তাত্ক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যপাশের অধিবাসীরা সাময়িক সময়ের জন্যে ভাগ্যবান হবেন। যদিও কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটের মধ্যে সেখানকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে সূর্যের বর্তমান পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি হবে এবং নেমে আসবে স্থায়ী অন্ধকার। পৃথিবী কক্ষপথে টিকে আছে সূর্যের ভরের কারণে, সূর্যের অভাবে পৃথিবী তখন মহাকাশে ভাসতে শুরু করবে।

তবে, আরেকটা সুখবর হচ্ছে, কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে মহাকাশে ভাসতে ভাসতে পৃথিবী অন্য একটা সৌর জগতের কক্ষপথে আটকে যেতে পারে। তবে, সেখানে আমাদের সূর্যের মতো সমান আলো ও তাপ নিশ্চিত করা কোনো নক্ষত্র থাকতে হবে।

বিস্ফোরণের প্রভাব

যদিও ততদিনে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে, সূর্যে বিস্ফোরণের ব্যাপারে যদি আগাম তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে একটা দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে প্রাণ টিকিয়ে রাখার উপায় বের করা সম্ভব। যত দিনের খাদ্য সংরক্ষণ করে রাখা যায়, ততদিন টিকে থাকতে পারবে।

সেজন্যে খাবার ও টিকে থাকার উপাদান নিয়ে মানুষকে পৃথিবী পৃষ্ঠের অনেক গভীরে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হবে। সূর্যে বিস্ফোরণ ঘটার এক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসবে।

এক বছরের ভেতর তা মাইনাস ৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যেতে পারে। ফলে একদম তলানি থেকে উপরে পর্যন্ত মহাসাগরগুলোর পানি বরফে পরিণত হবে। এক হাজার বছরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বরফ হয়ে যাবে এবং ধসে পড়বে। যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তা মহাজাগতিক বিকিরণ ও গ্রহাণুর আঘাতে বিধ্বস্ত হবে। তবে, ততদিনে পৃথিবী কোনো বাসযোগ্য সৌরজগতের খোঁজ পাবে বলে আশা করা যায়।

অন্যদিকে, সূর্য বিস্ফোরিত হলেও তা রাতারাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না, বরং ধ্বংস হওয়ার দীর্ঘ, ধীর, ও কঠিন প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে আনুমানিক আরও শত কোটি বছর লেগে যাবে। ধীরে ধীরে সূর্য আরও গরম ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং এটি প্রসারিত হতে শুরু করবে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন, সূর্য তার মহাজগতের বাইরের স্তরগুলো হারাবে। যার ফলে বিগ ব্যাং-এর মতো ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে ও পৃথিবীর মতো আরও অনেক নক্ষত্র এবং গ্রহের সৃষ্টি হবে। ঠিক যেমন একটি বিস্ফোরণে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল।

কে জানে, হয়তো এসব নক্ষত্রের কোনটায় নতুন জীবন গঠন হতে পারে। আমাদের ছায়াপথ এখন থেকে শত কোটি বছর পর কেমন দেখতে হবে তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবে, এই ছায়াপথে সোনালি আভা ছাড়া কোনো সৌরজগৎ কল্পনা করা কঠিন। সূর্যের কেন্দ্রের অতি উত্তপ্ত ও উজ্জ্বল চুম্বকত্ব, আমাদের সৌরজগতের অভিকর্ষ সৃষ্টি করে গ্রহ নক্ষত্রগুলোকে একত্রে রাখে।

আলো ও শক্তি দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে সূর্য। তবে, সূর্য বিস্তৃত হতে হতে একটা সময় গিয়ে সংকুচিত হবে। মূলত অন্য কোনো সৌরজগৎ বা সূর্যের মতো কোনো নক্ষত্রের জন্য স্থান ত্যাগ করতে নিজে ধ্বংস হবে। অলৌকিকভাবে ততদিন পর্যন্ত যদি পৃথিবীতে মানুষ টিকে থাকতে পারে তবে, তাদের স্থান কোথায় হতে পারে সে বিষয়ে আরেকদিন আলোচনা হবে।

এসএইচ-০২/০৭/২২ (প্রযুক্তি ডেস্ক, সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার)