অভিবাসী শ্রমিকরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার

এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে অভিবাসী শ্রমিকের মানবাধিকার সমস্যা সমাধানে বিনিয়োগকারী এবং অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয় ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করে ‘নিক্কেই এশিয়া’ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

অভিবাসী শ্রমিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের খ্যাতিমান কোম্পানিগুলোতে, বিশেষ করে সাপ্লাই চেইন নির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠাগুলোতে ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মানবাধিকার নীতির প্রচলন এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।

ক্রমবর্ধমান এশিয়া প্যাসিফিক অর্থনীতিতে মানবাধিকারের ঝুঁকির মাত্রা সব থেকে বেশি। বিভিন্ন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কারখানাগুলোতে বিশেষ করে যেসব কারখানা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কর্মী বাধ্যতামূলক শ্রম ও বকেয়া বেতন পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি একটি আলোড়ন সৃষ্টি করা অভিযোগ উঠেছে আন্তর্জাতিক মানের অস্ত্রোপচারের গ্লোভ সরবরাহকারী কোম্পানি টপ গ্লোভের বিরুদ্ধে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন দাবি করেছে যে- মালয়েশিয়ার টপ গ্লোবের পরিচালিত কারখানায় জোরপূর্বক শ্রম, অবৈধ ওভারটাইম, বকেয়া বেতন পরিশোধ না করা এবং নিম্নমানের পরিবেশের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

এদিকে কর্মীদের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কিংবা অভারটাইম করাতে গিয়ে টপ গ্লোব কর্পোরেশন কোনো আইন ভাঙেনি বলে জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রী এম. কুলাসেগারান। তিনি এবং তার কর্মকর্তারা ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত রাবার গ্লোব কোম্পানিটির কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে জানান তিনি।

মালয়েশিয়ার সংবাদপত্র দ্য স্টার অনলাইন জানিয়েছে, গত বছরের ১০ নভেম্বর ক্লাং শহরে টপ গ্লোবের কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। টপ গ্লোবের প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. লিম উয়ি চাই এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য চার্লস সান্তিয়াগো তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।

গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে টপ গ্লোবে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করানো এবং ঋণের ফাঁদে আটকানোর অভিযোগ তোলা হয়। কারখানায় কর্মরত নেপালের আটজন এবং বাংলাদেশের আটজন অভিবাসী শ্রমিক গার্ডিয়ানের কাছে টপ গ্লোবের বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করে। তারা দাবি করে, সপ্তাহে সাতদিন কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করানোর পাশাপাশি মাসে একদিন ছুটি দেয়া হয়।

অভিযোগের পর কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শন করেন মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রী। শীর্ষ এই রাবার প্রস্তুতকারী কোম্পানিটি ভুল কিছু করেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কর্মীদের জন্য তাদের নিজস্ব কর্মপদ্ধতি (ম্যাকানিজম) রয়েছে এবং আমার মন্ত্রণালয়ের জানামতে তারা আইনি কাঠামোর মধ্যে কাজ করে’।

চাকরি (অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার সীমাবদ্ধতা) নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৮০ ঊদ্ধৃতি দিয়ে মন্ত্রী বলেন, আইন অনুযায়ী প্রতিমাসে ১০৪ ঘণ্টার অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ না করতে কর্মীরা বাধ্য। এটা চাকরিদাতার দিকেই যায়’, মন্তব্য করে তিনি বলেন চাকরিদাতারাও নিয়ম মানতে বাধ্য।

কুলেসাগারান এবং তার কর্মকর্তারা টপ গ্লোবের ৩৫টি কারখানার মধ্যে ২২টি কারখানার কর্মপরিবেশ পরীক্ষা করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কিভাবে এই অভিযোগ উঠলো তা নিয়ে আমি নিশ্চিত না। ‘ফেক নিউজ ছড়ানো’ উচিত হবে না।

প্রতিষ্ঠাতা লিম বলেন, মালয়েশিয়ার শীর্ষ রাবার গ্লোব রফতানিকারক কোম্পানি হিসেবে তারা ব্যবসায়িক নৈতিকতা, শ্রদ্ধা, সততা এবং স্বচ্ছতা অনুসরণ করে থাকে।

আট বছর পূর্বে জাতিসংঘ মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্পর্কিত গাইডলাইন দিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশে কোম্পানিগুলোর জন্য, তবুও এসব দেশগুলোতে মানবাধিকার জনিত সমস্যাগুলো এখনও ব্যর্থ হিসাবেই পরিগণিত হয়ে আসছে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঙ্গসংগঠন আসিয়ান ভুক্ত ১০টি দেশেও অভিবাসী শ্রমিকের অধিকারের প্রতি বেশিরভাগ মানবাধিকার সংস্থাগুলো সাড়া দিতে ধীর হয়ে পড়েছে।

গত মে মাসে প্রকাশিত আসিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত তালিকাভুক্ত শীর্ষস্থানীয় ২৫০টির মধ্যে মাত্র ১৮% সংস্থা মানবাধিকার নীতি প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, যে জরিপ করা সংস্থাগুলোর মধ্যে মাত্র এক চতুর্থাংশ সংস্থা মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ বা রিপোর্টিং সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করে। সামগ্রিকভাবে কোম্পানিগুলো জাতিসংঘ নির্দেশিকাকে উপেক্ষা করে মাত্র ২২% এরও কম মানবাধিকারজনিত তথ্য প্রকাশ করে।

অভিবাসী শ্রম বিশেষজ্ঞরা এই ফলাফলগুলো দেখে অবাক হতে পারেন কিন্তু, স্পষ্ট প্রমাণ দেয় যে এই অঞ্চলে অনেক কোম্পানি বৈশ্বিক কোম্পনিগুলোর থেকে মানবাধিকার বিষয়ে অনেকাংশে পিঁছিয়ে রয়েছে। কয়েকটি এনজিওর তৎপরতার কারণে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, থাই ইউনিয়ন বকেয়া বেতনের অভিযোগের ঘটনা রোধে এবং জোরপূর্বক শ্রমের ঘটনা নির্মূল করতে মিয়ানমারের যেসব অভিবাসী শ্রমিক থাইল্যান্ডের মৎস্য খাতে সামুদ্রিক প্রসেসিং করা চেইনের কারখানায় কাজ করে সেখানে কিছু সময় উপযোগী নিয়োগের নীতি গ্রহণ করেছিল এবং তদারকি বাড়িয়ে তোলে।

পশ্চিমা দেশগুলোতে এই সকল বিষয়ে যে কঠোরতার অবলম্বন করা হয় এই অঞ্চলে বেশিরভাগ কোম্পানিতে তেমন মাত্রার চাপ অনুভব করতে হয়নি। এই অঞ্চলে মানবাধিকার সংস্থাগুলিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া এবং অনেক প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতাও এর পিছনে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়।

তবে বিভিন্ন তদন্তকারী এবং অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং পাচার বিরোধী মানদণ্ডের সাথে সম্মতি রেখে উচ্চ প্রোফাইল আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলোতে বিশেষ করে কৃষি এবং ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিভিন্ন কোম্পানিগুলোতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মানবপাচার বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার ফলে অবস্থার বেশ কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গবেষণায় দেখা যায়, যে অভিবাসী শ্রমিকদের নির্যাতনের বেশিরভাগ ঘটনাই কাজ শুরুর প্রথম দিনের পূর্বেই বেশি ঘটে থাকে। এজেন্টদের দ্বারা নিয়োগ হওয়ার ফলে বিশাল অঙ্কের অর্থ নিয়োগ ফি হিসেবে খরচ করে শ্রমিকরা- এমন ঋণের ভারে নিমজ্জিত হয়ে আসে যা তারা আজীবনও শোধ করতে পারে না।

এরপর আবার যখন তারা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করে তখন আবার লড়াই করতে হয় আবাসন ও কর্মস্থলের খারাপ অবস্থা, উচ্চ ওভারটাইমের প্রয়োজনীয়তা এবং পাসপোর্ট জিম্মি করে রাখার মতো অবস্থার সাথে। কেউ কেউ এজেন্টদের দ্বারা নিযুক্ত হন এবং কারখানার থেকে কারখানায় ছোটাছুটি করে যেতে হয়, তাদের কাজের অবস্থার উপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

এসএইচ-০৫/২৪/১৯ (প্রবাস ডেস্ক)