মালদ্বীপে বিপদে বাংলাদেশি শ্রমিকরা

মালদ্বীপের মাথিভেরি দ্বীপের একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন বাংলাদেশের হৃদয় হোসেন। কিন্তু দেশটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর, গত দুই মাস ধরে তিনি বেকার।

”এখানে থাকা-খাওয়ায় অনেক খরচ। হাতে যেটুকু টাকা পয়সা ছিল, সব শেষ। বাড়ির অবস্থাও বেশি ভালো নয় যে, সেখান থেকে টাকাপয়সা এনে খরচ চালাবো। আসলে খুব বিপদে পড়েছি।” তিনি বলছিলেন।

তার মতো এরকম বিপদে পড়েছে মালদ্বীপে থাকা হাজার হাজার বাংলাদেশি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতি বলেছে, মালদ্বীপে বিদেশি শ্রমিকরা কোভিড-১৯ এর কারণে যে হয়রানির শিকার হচ্ছে, তাতে তারা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তারা মালিকদের দ্বারা হয়রানি, মজুরি কম দেয়া,পাসপোর্ট আটকে রাখা, অনিরাপদ পরিবেশে থাকতে ও কাজ করতে বাধ্য করা, চাকরিচ্যুতি, অতিরিক্ত সময়ে কাজ করানো, শ্রম অধিকারের লঙ্ঘনের মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে, বলছে সংস্থাটি।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং লকডাউন এসব অবস্থার আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। সেই সঙ্গে চাকরিচ্যুতি, বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা, বেতন কমিয়ে দেয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে তারা।

বিপদে বাংলাদেশি শ্রমিকরা

মালদ্বীপে ১ লাখ ৪৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৩০ হাজারের মতো বিদেশি শ্রমিক কাজ করে। জাতিসংঘের এপ্রিল মাসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এদের বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নাগরিক, যাদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন।

এরা মূলত দেশটির পর্যটন খাতে কাজ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে গত মার্চ মাস থেকেই এই খাত অনেকটা স্থবির হয়ে রয়েছে।

হৃদয় হোসেন এখন মালের যে বাসায় ভাড়া থাকেন, সেখানে আরও ১৪জন বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১২ জনের এখন কোন কাজ নেই। যদিও করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে তারা দেশটির বিভিন্ন রিসোর্ট বা রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন।

তিনি বলছেন, ”দুই জন ছাড়া আমাদের বাকিদের কারো কাজ নেই। করোনাভাইরাসের কারণে পর্যটনের সব কিছু বন্ধ হয়ে আছে। অথচ থাকা খাওয়া নিয়ে মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা লাগে।”

দেড় বছর আগে বাংলাদেশ থেকে তিনি মালদ্বীপে গিয়েছেন।

আরেকজন শ্রমিক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, তিনি একটি রিসোর্টে কাজ করতেন। করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হওয়ার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকমাস মালিক, শ্রমিকদের বেতন না দিলেও খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে এখন তাদের সবাইকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে।

”মালিক বললো, তোমরা মালে (রাজধানী) চলে যাও। এখানে আর তোমাদের রাখতে পারছি না। এরপর গত দুইমাস ধরে মালের এই বাসা ভাড়া করে আমরা অনেকে থাকছি।”

তিনি জানান, তারা বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিমানের এতো ভাড়া যে, সেটা বহন করার সামর্থ্য তাদের নেই।

মালদ্বীপের সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদেশি শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। কিন্তু যতজন শ্রমিককে পাঠানো হয়, দেশে ফেরত যেতে চাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। গত কয়েকমাসে সাড়ে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন।

হৃদয় হোসেন বলছেন, ”দুই মাস আগে হাইকমিশনে নাম জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো দেশে যাওয়ার তালিকায় নাম ওঠেনি।”

হয়রানি আর নির্যাতনের শিকার শ্রমিকরা

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, মালদ্বীপে নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই শ্রমিকরা নানা হয়রানি ও শোষণের শিকার হচ্ছে।

কাজের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হয় শ্রমিকরা, কিন্তু মালদ্বীপে গিয়ে তারা প্রতারণার শিকার হন। সেখানে তাদের অনেক কম বেতনে, কখনো কখনো কোনরকম চাকরি ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়। অনেক সময় এজেন্ট বা চাকরিদাতা তাদের পাসপোর্ট আটকে রাখে।

অনেক সময় অভিবাসী শ্রমিকরা ‘কোটা ট্রেডিং’ এর শিকার হন। অর্থাৎ নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের চাহিদার চেয়ে বেশি শ্রমিকের অনুমতি নিয়ে শ্রমিক আনেন। পরে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়।

তাদের এমন পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা হয় যেখানে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব রয়েছে। এরকম পরিবেশ তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, শ্রমিকদের সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না মালদ্বীপের সরকার।

এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় মালদ্বীপের সরকার তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ঘোষণা করে আটক করতে শুরু করে। শুধুমাত্র জুলাই মাসে বিক্ষোভে অংশ নেয়া ৮০ জন অভিবাসী শ্রমিককে আটক করা হয়েছে।

২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ কর্মী নেয়া বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মালদ্বীপের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ, সেটি আরও একবছর বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ কি করছে?

মালদ্বীপে কর্মরত শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের এই সংকটের সময় তারা সেখানকার হাইকমিশন থেকে তেমন সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

তবে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মালদ্বীপের শ্রমিকদের সমস্যার বিষয়টি তাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। বাংলাদেশে হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে তারা কাজ করছেন।

এসএইচ-০৫২৬/২০ (প্রবাস ডেস্ক)