”পৃথিবী জুড়ে দারিদ্রের চেহারা সবখানে একই। তাদের গল্পগুলোও একই। আর সেই দারিদ্রের পেছনের মূলে থাকে কিছু ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী। যাদের কারণে এই দারিদ্রের চেহারা কখনো বদলায় না।
সে আমি পাকিস্তানে যাই, বা পেরুতে, সাউথ সুদান অথবা রাশিয়ার কোন দরিদ্র শহরে। দারিদ্রের চেহারা সবখানে একই। সবার চোখে একই প্রশ্ন – আমি বাঁচবো কীভাবে, খাবো কী, বেঁচে থাকবো কী করে” – এই অল্প কথায় যেন উন্নয়ন খাতের সবটাই বলে দিলেন বিশ্ব খাদ্য সংস্থার স্পেশালিষ্ট ওমর ফারুক সৌরভ।
পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতক করে কেয়ার ইন্টারন্যাশনালে গিয়েছিলেন একটি প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে। উল্টো তাকেই সেই প্রকল্পটি করতে প্রস্তাব দেয়া হয়। সেই থেকে শুরু।
সাইক্লোন সিডর থেকে শুরু করে পাকিস্তানের বন্যা, সাউথ সুদানের যুদ্ধাবস্থায় কাজ করা, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থী এবং বর্তমানে মিশরে দায়িত্বপালন।
দশ বছর আগে, ২০১১ সালে যখন ওমর ফারুক পাকিস্তানে ছিলেন তখন তার এক সহকর্মীকে অপহরণ করা হয়। অপহরণ সেখানে একটি ব্যবসা। আর তা এমন এক সময়ে যখন আল কায়েদার প্রাক্তন নেতা বিন লাদেন ইস্যুতে পাকিস্তান উত্তাল। ভয় পেতেন যে কোনো পাঁচ তারকা হোটেলে যেতে। কারণ কিছুদিন আগেই ম্যারিয়টে বোমা হামলা হয়।
যেদিন ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়, সেদিনও তারা ছিলেন বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলে একটি কর্মশালায়, বন্দী, ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়।
পাকিস্তানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়ালেও ঘরে থাকতো অফিস থেকে দেয়া হাইবারনেশন কিট – দু’সপ্তাহের শুকনো খাবার, যেন গৃহবন্দী থাকলেও বেঁচে থাকতে পারেন। বলাই বাহুল্য, দেশে তার পরিবার যেন তার চেয়েও দুশ্চিন্তায় থাকতো প্রতিদিনকার খবর পড়ে।
ওমর ফারুক হঠাৎ করেই ঝোঁকের বসে একবার চলে আসেন সাউথ সুদানে। তখন যুদ্ধ চলছে সেখানে। সেই যুদ্ধাবস্থায় কাজ করতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হত হেলিকপ্টার বা চার্টার প্লেনে। নেই কোন রানওয়ে। নামতে হয় মাটির উপর। তার উপর যদি বৃষ্টি হয় তবে ফেরা বন্ধ।
এদিকে হয়ত যাবার আগে মধ্যস্থতা করে গিয়েছেন ওই এলাকার ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে, কিন্তু যাওয়ার পর বন্দুক যুদ্ধে পাল্টে যেতে পারে ক্ষমতা – ফলাফল।
যে লজে থাকতেন সেখানে ভয় ছিল ধর্ষণের – ছেলে, মেয়ে নির্বিশেষে। একদিন যেন গান শটের আশংকায় সত্যিই মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছিলেন। সেই মিশন থেকে ফিরে আসার পরও তার চলাফেরা, কথা বার্তা যেন স্বাভাবিক হতে পারছিলো না।
একটি পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার পর আসলে বোঝা যায়, কতটা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে সেখানে যেতে হয়েছিল।
এই পেশায় যারা কাজ করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ভার বহন করেন হয়তো তার পরিবার। প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা, বিশেষ করে জীবনসঙ্গীকে অনেক ক্ষেত্রেই তার নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিতে হয় পাশে থাকার জন্য।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হল, এই পেশায় তুলনামূলকভাবে অধিক আয়ের সুযোগ থাকলেও, পড়াশোনায় খুব ভালো যারা করেন, সাধারণত তাদের আসতে দেখা যায় না। কমবেশি সবারই ইচ্ছে থাকে উন্নত বিশ্বে বা নিজের দেশে ঠিকানা গড়ার, অথবা প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা বা ইউএনডিপির ইথিওপিয়া কান্ট্রি রেপ্রেজেন্টেটিভ তুরহান সালেহ ইটালির স্কুল এবং আমেরিকার অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় নিউইয়র্কে কাটালেও, পেশাগত জীবনে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন গানা, ইরিত্রিয়া, নাইজেরিয়া এবং বর্তমানে ইথিওপিয়ায়।
তার কাছে এ যেন মন ও মানসিকতাকে বড় করার সুযোগ। সুযোগ ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিকে জানা। সেই সঙ্গে সমাজ, দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তার আগ্রহের জায়গা থেকে কাজ করার সুযোগ। কিন্তু এ পাওয়ার পেছনে ছাড়ও অনেক। পরিবার, প্রিয়জনের দু:সময়ে হাজার মাইল দূরে থাকার যন্ত্রণা যেন সেই অর্থ কখনো মেটাতে পারে না।
দু’হাজার সাত সালে নাইজেরিয়ার নির্বাচনের সময় আয়োজন করেছিলেন একটি রাজনৈতিক আলোচনার। হঠাৎ করেই হল রুমে এসে পড়লো বন্দুকধারী দল। এদিকে অপর পক্ষের হাতেও বন্দুকের বহর। সে ছিল এক মুহূর্তের ব্যাপার, বন্দুক যুদ্ধ শুরু হতে।
ভাগ্য সহায় ছিল তুরহান সালেহের। শুধু সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান নি, বেঁচে গিয়েছিলেন আরেকটি বড় দুর্ঘটনা থেকেও। তিনি নাইজেরিয়া ছেড়ে আসার ছ’মাস পরেই সেখানকার ইউএন অফিসে বোমা হামলা হয়। তার অনেক সহকর্মী ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এমার্জেন্সি রেসপন্সে বেতন প্রায় চার- পাঁচ গুন বেশি। একক অভিভাবক হিসেবে ব্র্যাকের হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের এরিয়া ডিরেক্টর হাসিনা আখতার হক তার দু’সন্তানকে আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে ঝুঁকি নিতে কোন ভয় পাননি। কাজ করেছেন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, কেনিয়া, তানজানিয়া, মালাউই এমনকি ইবোলাগ্রস্ত উগান্ডাতেও সেই মহামারীর সময়ে।
আফ্রিকান দেশগুলোতে বন্দুকযুদ্ধ যেন সাধারণ ব্যাপার। অভিজ্ঞতা হয়েছে কয়েকবার এমনি যুদ্ধাবস্থায় আটকে পরার। ঠিক ওই সময়গুলোতে মনে হয় খুব বেশি দূরের চিন্তা ভাবনা করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠে না। হাসিনা আখতারও তার ব্যতিক্রম নন- নিজের মা আর, নিজের দু’সন্তান আর নিজের জীবনের কথাই তখন ভেবেছেন।
”দেশে থাকতে আমরা অনেক কিছু নিশ্চিতভাবে ধরে নেই। কিন্তু এই পেশাগত জীবন যেন আগে থেকেই অনেক কিছু গোছাতে শেখায়,” তিনি বলেন।
তিনি আগে থেকেই ভেবে রাখতেন এ ধরনের কোন পরিস্থিতিতে কিছু হলে তার সন্তানদের কী হবে। তবে তিনি বলেন, এর কারণে কখনো দুর্গম অঞ্চলে যেতে দ্বিধা করেন নি।
”যদি আমি না যাই, আমার সঙ্গে যারা কাজ করে, তারা সহজে সাহস পাবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের দু:খ-কষ্ট, যন্ত্রণা এতো কাছ থেকে দেখার পর তখন নিজের না পাওয়াগুলোকে অনেক ছোট মনে হয়,” তিনি বলেন।
তিনি তুলে ধরেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যোগ্যতা থাকার পরও বাংলাদেশী মেয়েদের এই পেশায় এগিয়ে যাওয়া কত কঠিন। অনেকের ক্ষেত্রেই স্বামী বা বাবা-মা প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ দিয়ে থাকেন চাকরি ছেড়ে দেশে চলে যাবার জন্য। অথচ এমন এক বৈশ্বিক মহামারির সময়ে তার হয়ত কর্মক্ষেত্রেই থেকে যাওয়া ভালো, অন্তত চাকরিটা তো আছে।
কিন্তু আমাদের এ সমাজ যেন তা বুঝতে চায় না। এমনকি এই চাপের কারণে হয়ত আমাদের মেয়েরা সে সব দেশে নিজের বন্ধু-বান্ধবও সেভাবে গড়ে তুলতে পারে না। অন্যদিকে এই পেশায় যারা আছেন, তারা হয়ত একটা সময়ের পর হয় দেশে বা বিদেশে ভালো ভাবে স্থায়ী হবার কথা চিন্তা করেন।
পাকিস্তানকে বেশি দেখেছেন পাকিস্তানিদের চাইতেও- এমনটিই দাবী করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইস্টার্ন মেডিটেরিয়ান রিজিওনাল অফিসের ভারপ্রাপ্ত রিজিওনাল এডভাইজার কামরুল হাসান। এক বছর এক বছর করে কাটিয়ে এসেছেন দশটি বছর পাকিস্তানে, গিয়েছেন প্রত্যন্ত বা দুর্গম অঞ্চলে যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তা আর্থিক কারণেই হোক বা নিরাপত্তা বা যোগাযোগ জনিত কারণে। কিন্তু এ ধরনের সংস্থার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তার পক্ষে যাওয়াটা সম্ভব ছিল।
প্রতি মাসের অর্ধেকই হয়ত তখন তিনি কাটিয়েছেন বাইরে। পাকিস্তান থেকে মিশরে। তারপর হার কিছুটা কমলেও ভ্রমণ ছিল তার প্রতি মাসের রুটিনের মধ্যে – এবং তা বিশ্ব জুড়েই।
কামরুল হাসানের কাছে ভালো লাগলেও বিষয়টা সুখকর ছিল না তার স্ত্রীর জন্য। কারণ তাকে একা থাকতে হতো কায়রোতে। এই জীবন ঘরকুনো বাঙালি সবাই কি নিতে পারে? ”এটি নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের ওপর। অনেকেই পারে না আবার অনেকেই পারেন,” তিনি বলেন।
তার কাছ থেকে আরো জানা যায়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের দেখভালের জন্য কতটা সদা তৎপর।
পাকিস্তানে একবার তিনি পড়েছিলেন ভয়ংকর শারীরিক অসুস্থতায়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সব কিছুর দেখাশোনা করেছে তার অফিস। এদিকে এখন করোনার কারণে ভ্রমণ একেবারেই কমে গেলেও তার প্রভাব চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে পড়বে না বলে তিনি মনে করেন।
এই সংস্থাগুলো থেকে স্থানভেদে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর বিনোদনের জন্য ছুটি পাওয়া যায় কাছের কোন দেশে যাওয়ার জন্য। সেটা হতে পারে ব্যাংকক বা দুবাই। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আবার তারা ফিরে যান কর্মস্থলে। হাতে গোনা কয়েকজন বাংলাদেশি থাকায়, অনেকের মাঝে সখ্যতাও গড়ে উঠে।
আর এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে যুদ্ধপীড়িত বা দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলোতে একেবারেই নিশ্চিত পরিচিতজন যেন বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো। তাদের আয়োজন করা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের যেন সেখানকার বাংলাদেশীরা কিছুটা হলেও দেশের স্বাদ পেতে পারেন।
তবে এই ধরনের আয়োজন বা সামাজিকতা অনেকটাই নির্ভর করে রাষ্ট্রদূতের এবং প্রবাসী বাঙালি যারা আছেন তাদের উভয় পক্ষের আন্তরিকতার উপর। এরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের পতাকা বহন করে চলেছেন ভিন্ন ভিন্ন দেশে, নিজ নিজ কাজের মাধ্যমে।
এসএইচ-০২/২৮/২১ (নওরীণ সুলতানা, বিবিসি)