বগুড়ার পোড়াদহের মেলায় ৭৩ কেজি বাঘাইড়

প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় বসে ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহের মেলা’। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বুধবার সূর্যোদয়ের পর থেকেই মেলামুখী সব সড়কে মানুষের ঢল নামে। এই মেলাকে বলা হয় মাছের মেলা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বড় সাইজের মাছের আমদানি হয় মেলায়। সেই সঙ্গে বড় (ছয় কেজি ওজনের) মিষ্টি তৈরি করা হয়।

মেলায় এবার বড় সাইজের মধ্যে ৭০ থেকে ৭৩ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ ওঠে একাধিক। এ ছাড়া নানা সাইজের নানা প্রজাতির মাছেরও দেখা মেলে মেলায়। বড় ও মাঝারি সাইজের ১৩টি বাঘাইড়, ২৫টি বোয়াল ও ২৭টি রুই-কাতলা নিয়ে মেলায় আসেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি এলাকার মাছ ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান। তিনি জানান, একটি মিনি ট্রাকে করে মাছগুলো মঙ্গলবার রাতেই তিনি নিয়ে আসেন। মাছগুলোর একেকটির ওজন গড়ে ৫০ কেজি।

লুৎফর রহমান আরও জানান, তিনি পেশায় মাছের পাইকারী ব্যবসায়ী। প্রতিনিয়ত মাছের কারবার করেন। কিন্তু পোড়াদহ মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে এক মাস আগে থেকে বড় সাইজের মাছ সংগ্রহ করতে থাকেন। মেলায় মাছ বিক্রি করে তার ভালো লাভ হয়। লাভের পাশপাশি এক ধরনের আনন্দও পান বলে জানান তিনি।

বুধবার মেলায় বড় সাইজের ৭৩ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ বিক্রি হয়েছে ১২শ’ টাকা কেজি দরে। এর বিক্রেতা ছিলেন বিফল সরকার নামে এক ব্যবসায়ী। তার ৭৩ কেজি ওজনের এই মাছটিই ছিল এবার মেলায় সবচেয়ে বড় আকারের মাছ। এ ছাড়া বড় সাইজের নানা প্রজাতির মাছও নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

মেলায় বাঘাইড়ের পাশাপাশি রুই, কাতলা, মৃগেল, ব্রিগেড, চিতল, সিলভার কার্প ও বোয়ালসহ অর্ধশত প্রজাতির মাছ কেনা-বেচা হয়। সাইজ অনুযায়ী প্রতি কেজি রুই ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, কাতলা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, ব্রিগেড ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং বোয়াল মাছ বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়।শহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বসা প্রাচীন এই মেলায় শুধু বগুড়ারই নয়, আশপাশের কয়েক জেলার মানুষও ভিড় করেন। প্রতি বছরের মতো এবারও তাদের সবার দৃষ্টি ছিল নানা প্রজাতির বড় বড় মাছের দিকে। এরপর তারা ভিড় জমান মাছসহ নানা ফলের আকৃতির মিষ্টির দোকানে। খাট ও সোফাসহ কাঠের নানা আসবাবের দোকানগুলোতেও কেনা-কাটায় ব্যস্ত ছিলেন অনেকে।

এবার মেলায় মাছ আকৃতির ছয় কেজি ওজনের ‘রুই মিষ্টি’ তৈরি করেন গাবতলীর সৈয়দ আহম্মেদ কলেজ স্টেশন এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক। প্রতি কেজি ৩০০ টাকা হিসেবে বড় ওই মিষ্টির দাম ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকা। আব্দুর রাজ্জাক জানান, মেলা উপলক্ষে তিনি বিভিন্ন রকম মাছের আকৃতির মিষ্টি তৈরি করেছেন।

পোড়াদহের মেলাটি একদিনের হলেও আশপাশের গ্রামে জামাই উৎসব চলে তিনদিন। মেলায় ওঠা বড় মাছ আর হরেক মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের পাশাপাশি উপহার হিসেবে তাদের জন্য কেনা হয় কাঠের আসবাব। বৃহস্পতিবার ওই স্থানেই বসবে ‘বউ মেলা’। সদ্য বিবাহিত নারী অর্থাৎ নতুন বউদের জন্য চুড়ি, ফিতা ও কানের দুল এবং ইমিটেশনের গহনাসহ রূপচর্চার নানা সামগ্রীতে ঠাসা থাকবে দোকানগুলো। পোড়াদহের মেলা উপলক্ষে বাবার বাড়িতে নাইওরে আসা নারী এবং স্থানীয় নববধূরাই ‘বউ মেলা’র প্রধান ক্রেতা।

প্রবীণদের বর্ণনা মতে, প্রায় দেড়শ’ বছর আগে পোড়াদহ এলাকায় আশ্রয় নেওয়া এক হিন্দু সন্ন্যাসীর স্মরণে সেখানে প্রতি বছর মেলার আয়োজন চলে আসছে। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস মতে, ওই সন্ন্যাসী যে মরা বটগাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন দীর্ঘ সাধনার পর সেটি আবার জীবিত হয়। এজন্য ওই স্থানটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে আজও পূজনীয়। সে কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মেলাটি ‘সন্ন্যাস মেলা’ নামেও পরিচিত।

মেলার পার্শ্ববর্তী পাঁচমাইল এলাকার রহিমা বেগম জানান, মেলা উপলক্ষে জামাইদের দাওয়াত দেওয়া বাধ্যতামূলক। তিনি বলেন, ‘ঈদে দাওয়াত না করলেও জামাইরা মন খারাপ করে না, কিন্তু মেলায় না ডাকলে তারা কষ্ট পায়।’

মেলার আয়োজক পোড়াদহ সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শঙ্কও কুমার রায় জানান, সামাজিকভাবে এই মেলার গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ এই মেলাকে ঘিরেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ভেদাভেদ ভুলে উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে।

স্থানীয় মহিষাবান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেলা কমিটির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, মেলাটি এলাকার ঐতিহ্যবাহী মেলা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কিছু স্বার্থান্বেষী দক্ষিণ গাবতলী উপজেলার আরও কয়েকটি এলাকায় একই দিনে বিচ্ছিন্নভাবে মেলার আয়োজন করায় মূল মেলার ওপর প্রভাব পড়ছে।

বিএ-১৫/১২-০২ (উত্তরা)