করোনা যোদ্ধা এক ডক্টরের শেষ পরিনতি!

যোদ্ধা

জি. এম. মুরতুজা: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক করোনা যোদ্ধা ডক্টরের ডাইরী থেকে আজকে একটা ঘটনা শেয়ার করি। অনুরোধ দয়া করে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
………….
আমাদের COVID ICU তে একজন ডাক্তার ভর্তি। বয়স ৩৮ বছর। খুবই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছেন। বাংলাদেশের বেস্ট পসিবল কোভিডের চিকিৎসা উনি পেয়ে গেছেন। উনি আমাদের মতই কোভিড রুগী দেখতেন সেই শুরু থেকেই। কিন্তু আজ তিনি নিজেই কোভিড-19 এর ভয়াল থাবায় কাবু। তারপর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট, তারপর ভর্তি আমাদের হাসপাতালের কেবিনে। তাঁর অক্সিজেন ক্রমাগত কমতে থাকায় তাঁকে ICU তে শিফট করা হয়। আমরা প্রথমে ১৫ লিটার অক্সিজেন দিয়ে চেষ্টা করলাম, কাজ হলো না। শুরু করলাম High flow nasal cannula (HFNC) দিয়ে ৫০ লিটার দেয়া, কাজ হলো না। ৬০ লিটার দিলাম, কাজ হলো না। দিন কে দিন খারাপ হতে লাগলো উনার অবস্থা। দেয়া হলো করোনায় ব্যাবহৃত সবচেয়ে দামী ওষুধ গুলো, যার কোনো কোনোটার একটি ভায়াল এর দাম ৭৫ হাজার টাকা থেকে ৮২ হাজার টাকা। হলো না কাজ।

অক্সিজেন কমতেই থাকলো Day by day। উনার স্ত্রী সবই বুঝতেছেন। ডাক্তারের বউ, স্বাভাবিকভাবেই একটু শক্ত হয় মানসিক দিক দিয়ে। আমরা অক্সিজেন বাড়িয়ে ৭৫ লিটার করলাম, কাজ হলো না। লাইফ সাপোর্ট মেশিন দিয়ে গত পরশু রাত ৩ টায় আমি শুরু করে গেলাম NIV (Non Invasive ventilation)। অক্সিজেন ৯৫% পর্যন্ত উঠলো সেদিন। আজ এসে দেখি NIV তেও হচ্ছে না। অক্সিজেন লেভেল ৮০% এর নিচে নেমে যাচ্ছে। ডাক্তার সাহেব যথেষ্ট শক্ত মানুষ। আমি গিয়ে হাত ধরলাম। বললাম শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি আপনার দাদা? NIV থাকায় কথা তো বলতে পারছেন না। মাথা নেড়ে কষ্ট চেপে একটু হাসলেন। বুঝালেন না হচ্ছে না। খেয়াল করে দেখছি শুরু থেকেই এই মানুষটা কাছে গেলেই হাসি দেয়। অক্সিজেন লেভেল ৭০ এ নামলেও উনার কষ্ট হয় না। হাসি মুখে লেগেই আছে। আজ সব রিপোর্ট রিপিট করলাম। বুকের এক্সরে আবার করলাম। মাত্র একদিন আগের বুকের এক্সরে যথেষ্ট খারাপ ছিলো। আজকের এক্সরে তাকেও ছাড়িয়ে গেল। বাকি রিপোর্ট গুলো ভয়াবহ খারাপ। বুকের এত বিভৎস এক্সরে খুব কমই দেখেছি।

বাতাস ধরে রাখবে এমন কোনো জায়গা তার বুকে নেই। আমরা তো আমরা, ছোট ডাক্তার। আমাদের বড় বড় কনসালটেন্ট স্যারেরা সবাই দিশেহারা। বোর্ড মিটিং একের পর এক। কোভিড নিয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রের সব বিদ্যা প্রয়োগ শেষ। কিন্তু কোন উন্নতি নেই। উনি যেহেতু ডাক্তার, তাই উনার কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে এক্সরে ফিল্ম দেখতে হয়, যেন উনি ফিল্মটা না দেখতে পান। উনি আমাকে মাথা নেড়ে NIV থেকেই ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন ভাই, আমার এক্সরের কি অবস্থা। আমি হাসি দিয়ে মিথ্যা বললাম ভালো আছে। উনার স্ত্রীকে ডেকে পাশাপাশি আগের এক্সরে আর আজকের টা দেখালাম। স্ত্রীর বয়স মনে হয় ৩২/৩৫ এর বেশি না। শিক্ষিত উচ্চ বংশীয় মানুষ। কথাবার্তায় বেশ বোঝা যায়।

উনি কিছুক্ষণ চুপ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হুট করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরো ডাক্তার রুমে আমরা সবাই নিস্তব্ধ। উনি কাঁদছেন। হাউমাউ করে কাঁধছেন। আমরাও চোখে পানি ধরে রাখতে পারলাম। রুমে সবাই চুপ। কিন্তু খেয়াল করলাম সকলের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন আর কি কিছুই করার নেই দাদা? আমরা চুপ। কারন আমাদের হাতে আর একটাই অপশন ডাক্তার সাহেবকে ফুল লাইফ সাপর্টে দিয়ে দেয়া। কিন্তু তাতে আশা বাড়বে না। কারণ কোভিড রুগী লাইফ সাপোর্টে গেলে ফেরার সম্ভবনা ০.১%। বলতে বলতেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কান্না সামলিয়ে বললেন। আমি আর কি করতে পারি ডক্টর বলে দিন? আমার উত্তর ছিলো, you did your last of the last Madam. keep praying to god. Lets hope for the best. 😔

শেষ পর্যন্ত এই ডক্টর মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করলেন। একজন সত্যিকার নায়কের করুন মৃত্যু হলো, যিনি দেশের করোনা রুগীদের সেবা দিয়ে অনেককে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন, তিনি এই সেবা দিতে গিয়েই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। ইনিইতো সত্যিকার নায়ক, বীর যোদ্ধা। স্যালুট জানাই আপনাকে। 😢
…………

আপনি বাইরে যাচ্ছেন? শপিংয়ে যাচ্ছেন? আড্ডাতে যাচ্ছেন? ডেটিং এ যাচ্ছেন? দোকান গুলোতে হয়তো অনেক আধুনিক ডিজাইনের জামাকাপড় আছে? ফাস্টফুডের দোকানেও মুখরোচক অনেক খাবার আছে? আপনার পকেটেও অনেক টাকা আছে।

কিন্তু এই টাকা কি আপনাকে বাঁচাতে পারবে? পারবে না! হ্যাঁ সত্যিই বলছি কোটি কোটি টাকাও আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। যেমন বাঁচাতে পারেনি এই করোনা যোদ্ধা ডক্টরকে। তাই যদি বাঁচতে চান, তবে এখন বাড়ীতে থাকুন। পরিবারকে সময় দিন। বাবা মা’র যন্ত নিন। সন্তানদের দেখভাল করুন। নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখুন। আর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন তিনি যেন এই মহামারী থেকে আমাকে, আপনাকে, সবাইকে রক্ষা করেন। সবাইকে ভালো রাখেন। পৃথীবিকে আবার সুস্থময় সময় ফিরিয়ে দেন।
(সংগ্রহীত ও সম্পাদিত)