রাবির পরবর্তী উপাচার্য কে হচ্ছেন?

গত ৭ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহানের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিনি দুই মেয়াদে রাবির উপাচার্য ছিলেন। প্রথম মেয়াদের মতো দ্বিতীয় মেয়াদেও অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে নিজেকে বিতর্কিত করেছেন অধ্যাপক আব্দুস সোবহান। সর্বশেষ মেয়াদের শেষের দিন বিতর্কিত নিয়োগ দিয়ে বর্তমানে টক অব দ্যা কান্ট্রি তিনি। তবে এর রেশ কাটতে না কাটতেই এখন আলোচনার তুঙ্গে, কে হচ্ছেন রাবির পরবর্তী উপাচার্য?

বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, স্বচ্ছ ও নীতিবান কেউ আসুক উপাচার্যের দায়িত্বে। যিনি হবে শিক্ষাবান্ধব ও গবেষণানুরাগী। ছাত্র প্রতিনিধি ও রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চার পথকে যিনি উন্মোচন করবেন এবং কাজের স্বচ্ছতার জন্য সর্বদা জবাবদিহি করবেন। কোনো নিয়োগ বাণিজ্যে জড়াবেন না— এমন একজনকেই ভিসি হিসেবে দেখতে চান তারা।

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিনেটের মাধ্যমে তিনজনের একটি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হয়। সেখান থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেন চ্যান্সেলর তথা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ এই আইনের মাধ্যমে সিনেট থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময় অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আর কোনো উপাচার্য সিনেট প্যানেলে নির্বাচিত হননি। পরবর্তী সময়ে সরকারি দলের পছন্দের শিক্ষকদের এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এবার বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্ভাব্য উপাচার্য হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক লাইব্রেরি প্রশাসক ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুন্নবী সামাদী, প্রাণ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল্লাহ, বর্তমানের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. জিনাত আরা।

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়েন সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। এজন্য উপাচার্য পদে একজন ভালো ও শিক্ষানুরাগী শিক্ষককে পেতে চাইছেন সাধারণ শিক্ষকরা। কেমন উপাচার্য চান জানতে সিন্ডিকেট সদস্য ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এই কয়েকদিন ধরে যে ঘটনা ঘটল, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মান অনেক হারিয়ে ফেলেছে। এটা ফিরিয়ে আনার জন্য সেরকম একজন দরকার, যিনি লেখাপড়া নিয়ে থাকবেন এবং শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে কাজ করবেন।’

শুধু নিয়োগ বাণিজ্য দেওয়া, দলবাজ, দলীয় কোন বিষয়ে কার সুবিধা হলো, কার অসুবিধা হলো— এগুলো নিয়ে যারা ভাবেন বা কথা বলেন, তাদের ভিসি না করার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরা।

রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর মতে, একজন শিক্ষাবান্ধব ও গবেষণানুরাগীকে রাবির ভিসি হিসেবে আনা হোক। যার মাধ্যমে রাবি ক্যাম্পাস কলুষমুক্তভাবে চলবে।

রাবি ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সুলতানুল ইসলাম রাহী বলেন, ‘আমাদের সাবেক ভিসি এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। এবং বলাই বাহুল্য তিনি একজন দলকানা ভিসি ছিলেন। তার সর্বশেষ নিয়োগ ও ছাত্রলীগ সম্পর্কে বক্তব্যে তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। তাই ছাত্র সংগঠন হিসেবে আমরা ক্যাম্পাসে সবদলের সহাবস্থান চাই। এটি যিনি নিশ্চিত করতে পারবেন আমরা তাকেই ভিসি হিসেবে চাই। ভিসি হবেন সর্বোচ্চ দুর্নীতিমুক্ত ও নীতিবান।’

রাবি ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত হোসেন মিলন বলেন, ‘বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রনেতা হিসেবে আমরা চাই ৭৩-এর অ্যাক্ট অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত একজন ভিসি। যিনি ছাত্র প্রতিনিধি ও রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চার পথকে উন্মোচন করবেন এবং তিনি তার কাজের স্বচ্ছতার জন্য সর্বদা জবাবদিহি করবেন। দলীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের হাত থেকে ক্যাম্পাসকে রক্ষা করে শিক্ষার গুণগতমান এবং ভয়মুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে পারবেন এমন ভিসি আমরা প্রত্যাশা করি।’

২০১৭ সালের ৫ মে দ্বিতীয় বারের মতো ভিসি হয়ে অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের কর্মকাণ্ড ভিসি পদটিকে বিতর্কিত করেছেন বলে মত অনেকের। শুধু তাই নয়, বিদায়ের কয়েক ঘণ্টা আগেও গণনিয়োগ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। সেজন্য প্রফেসর সোবহানের মতো আরেকজন রাবির ভিসি হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাবান্ধব সৎ, যোগ্য ও দক্ষ একজন কাউকে রাবির ভিসি করার দাবি সর্বমহল থেকেই উঠেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও চাইছেন একজন সৎ ও দক্ষ কাউকে ভিসি করা হোক।

এই পদে সিলেকশন করার জন্য ইতো মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। আলোচনায় থাকা শীর্ষ নাম হিসেবে অধ্যাপক সাবেক উপ-উপাচার্য চৌধুরী সারওয়ার জাহানের কথা জানা গেছে। তিনি এর আগে ২০১৩-২০১৭ সাল পর্যন্ত উপ-উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও তার বড় সফলতা বলে মনে করা হয়, নিয়োগে স্বচ্ছতা। যেহেতু বর্তমানে নিয়োগ বাণিজ্যের কারণে রাবি সমালোচনার শীর্ষে, তাই চৌধুরী মো. সারওয়ার জাহানকে এই মুহূর্তে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।

আলোচনার শীর্ষে থাকা আরেকজন হচ্ছেন ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও রাজশাহী জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তার সততা ও দক্ষতা নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে কোনো মত-দ্বৈততা নেই।

তারপরই আলোচনায় আছেন অধ্যাপক ড. সফিকুন্নবী সামাদী। তিনি গত ৩০ বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন এবং বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় মহল জ্ঞাত। শিক্ষকতা জীবনের শুরু থেকেই তিনি আওয়ামীপন্থী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের একজন সদস্য হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। আওয়ামীপন্থী দলীয় শিক্ষকদের স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি কনভেনিং কমিটির একজন সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় ড. সামাদী হেকেপের একটি প্রোজেক্টে দুর্নীতি করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আনা হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরজমিনে এসে তারা তদন্ত করে পরিষ্কারভাবে রিপোর্টে বলেন যে, এই হেকেপ প্রোজেক্টে কোনো প্রকার দুর্নীতি হয়নি।

এছাড়া হঠাৎ-ই নতুন করে যার নাম উপাচার্য প্যানেলে উঠে এসেছে, তিনি হলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল্লাহ। বলা হচ্ছে, উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে তিনি। পাবনার নওদা গ্রামে ড. শহীদুল্লাহর বাড়ি। জামায়াত নেতা আব্দুস সোবহানের পরিবারের সঙ্গে ড. শহীদুল্লাহর সখ্যতার কারণ তাকে শেষ পর্যন্ত বিবেচনা করবে কি না- এ নিয়ে চলছে আলোচনা।

এছাড়াও রাবির প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের নামও উপাচার্যের দৌড়ে এগিয়ে। তিনি প্রথমে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে সদ্য সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবাহানের সঙ্গে আঁতাত করেন। তিনি সদ্য সাবেক উপাচার্যের সমস্ত অপকর্মে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র বলছে, এর পুরস্কার স্বরূপ প্রফেসর হাবিবুর রহমানকে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের একজন উপদেষ্টা কমিটির সদস্য এবং সর্বশেষ প্রফেসর আব্দুস সোবহানের গ্রুপ থেকে তিনি দলীয় স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছেন।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান এবং অধ্যাপক এম শহীদুল্লাহ এদের দুজনের যেকোনো একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সাবেক উপাচার্য আবদুস সোবহান আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদের দুজনার কেউ নিয়োগ পেলে আবদুস সোবহানের সমস্ত দুর্নীতি অনুমোদন পাবে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই।

বর্তমানে ভিসিরা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। এই সময়ে কেমন ভিসি দরকার? জানতে চাইলে রাবির সাবেক ভিসি ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার তিনটি মানদণ্ডকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। পাণ্ডিত্য, নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব। যা তার সততার মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হবে। এক কথায় এসব গুণ যার মধ্যে বিদ্যমান, তিনিই এ পদের জন্য যোগ্য।

তিনি বলেন, ‘এত যোগ্য শিক্ষক থাকার পরও পুনরায় একজনকে দায়িত্ব দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সুফল বয়ে আনে না। এমনটা হলে রাবির মতো একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় আবারও সংকটে পড়বে।’

অধ্যাপক খালেক বলেন, ‘সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের আইন নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। আমি সর্বশেষ সেই আইনেই নির্বাচন দিয়ে এসেছি ১৯৯৯ সালে। প্রতি চার বছর পর পর ভিসি নিয়োগ দেওয়ার কথা। তবে সেটি আর হয়নি। গত ২২ বছর থেকে সিনেট প্যানেল থেকে আসেনি। এটি হলে এতটা অবনতি হতো না, যেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ না দেওয়ায় বঙ্গবন্ধুর আবমাননা করা হচ্ছে। ৭৩-এর অ্যাক্ট শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন। আমরা সেই সময় অন্দোলন করেছিলাম। তিনি সম্মান দেখিয়েছিলেন। সব বিশ্ববিদ্যালয় তো পায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েও ধরে রাখতে পারল না। এটা শিক্ষকদের ব্যর্থতা।’

এসএইচ-১০/২৪/২১ (শিক্ষা ডেস্ক)