বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যা জানা প্রয়োজন

উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন আমাদের অনেকেরই। সব রকম প্রস্তুতি থাকলেও সঠিক তথ্য অজানা থাকার কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেকে। এজন্য জানা দরকার বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ঠিক কবে থেকে শুরু করবেন এবং কীভাবে আগাবেন।

আজকের প্রতিবেদনে আমরা আপনাকে জানাব বিদেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য যাবতীয় তথ্য ও উপাত্ত। আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে বিদেশে অধ্যয়নের যাবতীয় বিষয়গুলো।

যারা গ্র্যাজুয়েশন করতে যেতে চান

উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চান তাদের আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কোন বিষয়ে অধ্যায়ন করতে চান। আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের পর সেটার চাহিদা চাকরির বাজারে কেমন সেটা একটু ঢুঁ মেরে দেখা। এরপর পড়তে যাওয়ার দেশ নির্বাচনের বিষয়ে ও যে বিষয়ে পড়তে যাবেন সেই বিষয়টি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পড়ানো হয়, সেই বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া। সব তথ্য সংগ্রহের পর সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী পাড়ি জমাতে পারেন বিদেশে।

যারা মাস্টার্স ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে যেতে চান

আবার যারা ইতোমধ্যে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন তারা মোটামুটি বিষয় নির্বাচন করে রাখেন। কিন্তু মাস্টার্সের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিদেশে অধ্যায়ন করতে গেলে গ্র্যাজুয়েশনের বিষয়টি পাওয়া যায় না। তাই নিজের ক্যারিয়ার অনুযায়ী কোন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করলে ক্যারিয়ার আরও ঊজ্জ্বল হবে, সে বিষয়ে জানতে ও ভাবতে হবে। যারা বিদেশে পড়তে যেতে চান, তাদের উচিত হবে গ্র্যাজুয়েশন ৪র্থ বর্ষ থেকেই এ বিষয়ে খোঁজ- খবর নেওয়া। কোন দেশে যেতে কী কাগজপত্র ও কী যোগ্যতার প্রয়োজন পড়বে সে বিষয়ে ধারণা নেওয়া।

কোনটার জন্য কি কোয়ালিফিকেশন

যারা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যেতে ইচ্ছুক তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের জন্য প্রয়োজন গ্রাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশন (জিআরই)। আর যারা ব্যবসা অথবা মানবিক বিষয়ে পড়তে ইচ্ছুক তাদের জন্য আছে গ্রাজুয়েট ম্যানেজমেন্ট অ্যাডমিশন টেস্ট (জিম্যাট)। যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিদেশে যেতে চান অথবা বিদেশে কোনো কলেজে ভর্তি হতে চান তাদের জন্য স্কলাস্টিক অ্যাপিচিউড টেস্ট (স্যাট)। ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে আমেরিকাভিত্তিক জিআরই বা জিম্যাট প্রয়োজন হয় না। জিআরই বা জিম্যাটের মেয়াদ ৫ বছর থাকে। তবে ২-৩ বছরের বেশি সময় হলে প্রফেসররা আবার পরীক্ষায় বসার সাজেশন দিয়ে থাকে।

ইংরেজি দক্ষতায় কোনটা প্রয়োজন

ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতার প্রমাণের জন্য দরকার আইইএলটিএস বা টোফেল। এ দুটি পরীক্ষা মোটামুটি সব দেশেই গ্রহণযোগ্য। আইইএলটিএস মূলত যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ভাষাগত দক্ষতা যাচাই পরীক্ষা। তাই অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে আইইএলটিএস বেশি প্রাধান্য পায়। আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভাষাগত পরীক্ষার জন্য টোফেল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজের নির্বাচিত গন্তব্য অনুযায়ী, যেকোনো একটি পরীক্ষা দেওয়া উচিত। এ দুটো পরীক্ষারই মেয়াদ ২ বছর। তবে এ দুটো পরীক্ষা বাদেও অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায়। তাই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যে শুধু এই দুটো পরীক্ষা লাগবে বিষয়টা এমন না।

যেসব কাগজপত্র লাগবে

বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদনের শুরুতেই প্রয়োজন পড়বে বায়োডাটা, স্টেটমেন্ট অব পারপাস, মার্কশিট, আইইএলটিএস/টোফেল এর ফলাফল, ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট। এসব কাগজ দিয়ে আবেদন শুরু করার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কনফার্মেশন অব এনরোলমেন্ট পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট যেমন, জাতীয় পরিচয়পত্র, বিবাহের সনদ (যদি বিবাহিত হয়ে থাকেন), জন্ম সনদ, ট্যাক্স সনদ, ইত্যাদি দিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে মিলবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ।

কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন

বিদেশে অধ্যায়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন দেশে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোন বিষয়ে পড়তে যাবেন সে বিষয়ে ধারণা নেওয়া। কিন্তু কাছে দেশ নির্বাচন নিয়ে অনেকেই ঝামেলায় পড়েন। কারণ একেক দেশের যাচাই-বাছাই একেক রকম। আবার সব দেশের আচার-আচরণ, জীবন- জীবিকা, আবহাওয়া, স্কলারশিপের সুযোগ, পড়ার পাশাপাশি অথবা পড়া শেষে কর্মে প্রবেশের সুযোগ এক রকম নয়। তাই সব দিক বিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই সব সময় উচিত হবে কমপক্ষে এক বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া। এখানে তাড়াহুড়ো না করাই ভালো হবে।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের তালিকায় যেসব দেশ রাখে তাদের মধ্যে রয়েছে– যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, ব্রিটেন, চীন, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশ। এ দেশেগুলোর মাঝে কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষা পরবর্তী সিটিজেনশিপ লাভের সুযোগ বেশি।

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পরিমাণে রিসার্চ সেক্টর থাকায় এ দেশ সবার পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে পড়তে জিআরই/জিম্যাট/স্যাট এবং ভাষাগত দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে টোফেল-কে প্রাধাণ্য দেওয়া হয়। তবে কেউ যদি আইইএলটিএস দিয়েও আবেদন করতে চান, তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সেটা গ্রহণ করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিচার্স অ্যাসিট্যান্ট (টিএ) / রিসার্চ অ্যাসিট্যান্ট (আরএ) এর কাজ পাওয়া যায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জানতে ও আরও তথ্য নিতে এখানে ক্লিক করে বিস্তারিত দেখতে পারেন।

যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার খরচ বিশ্ববিদ্যালয় ও অবস্থান ভেদে অনেক তারতম্য হয়। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা যায়। এছাড়া নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও আবেদন করা যায়। ব্রিটেনে পড়তে শুধু আইইএলটিএস- এ ভালো স্কোর থাকলেই হবে। যুক্তরাজ্যে আইন, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য, বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় প্রশাসনের পড়ালেখার জন্য ভালো। এ দেশে পড়াশুনা শেষ করে পার্মানেট রেসিডেন্সি (পিআর) পাওয়া অনেকটা সহজ।

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া ভালো আইইএলটিএস স্কোরকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যদিও এটা প্রকাশ্যে বলা হয় না। আইইএলটিএস স্কোর ভালো থাকলে ভালো সুবিধা পাওয়া যায়। এ দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং বা সাইন্সে পড়তে আইইএলটিএস স্কোর ৭.০ চাওয়া হয়। এ দেশে পড়াশুনা শেষ করার পর ১.৫ থেকে ২ বছর সেখানে চাকরি করলে বেশ সহজেই পার্মানেট রেসিডেন্সি (পিআর) পাওয়া যায়। এ ছাড়াও এদেশে পড়াশোনা করার সময় পার্ট টাইম আর ছুটিতে ফুল টাইম চাকরি পাওয়া যায়।

কানাডা

বিদেশের উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকের পছন্দের দেশের তালিকায় কানাডা অন্যতম। শীত প্রধান এ দেশে পড়াশুনা শেষ করে পার্মানেট রেসিডেন্সি (পিআর) হয়ে যাওয়ার সুযোগ খুব বেশি। নান্দনিক এ দেশে নাগরিক সুবিধা ও উন্নত জীবন-যাপনের কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি আগ্রহী হয়। কানাডায় সিজিপিএ ও আইইএলটিএস স্কোরকে খুব প্রাধান্য দেয়।

ইউরোপ
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন- জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে জ্ঞান পিপাসুদের পছন্দের অন্যতম জায়গা। তাই আপনি আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে বেছে নিন। নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডে পড়তে এক পয়সাও ব্যয় হবে না কারণ, এসব দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আর যদি স্কলারশিপে পড়তে যান তাহলে অন্যান্য খরচের ব্যয় নিয়েও আর চিন্তা করতে হবে না।

কোন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্বাচন করবেন

দেশ নির্বাচনের পর আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনি ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং-এর সাহায্য নিতে পারেন। যেমন- কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ প্রদান করেন, আবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর পোর্ট-ফোলিও কতটা উজ্জ্বল হবে সেই সব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।

জনপ্রিয় স্কলারশিপ

বিদেশে উচ্চশিক্ষা মূলত ব্যয়বহুল। তাই অনেকের পক্ষে এ ব্যয় বহন করা বেশ কষ্টসাধ্য। এক্ষেত্রে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা মূলত স্কলারশিপের খোঁজ করে থাকে। এক নজরে দেখে নিন জনপ্রিয় স্কলারশিপ প্রোগ্রাম-

১। যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ স্কলারশিপ এবং শেভেনিং স্কলারশিপ

২। কানাডার হাম্বার ইন্টারন্যাশনাল এন্ট্রান্স স্কলারশিপ

২। জাপানের মনবুশো বৃত্তি ও মনবুকাগাকুশো বৃত্তি

৩। যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট ফরেন স্টুডেন্টস প্রোগ্রাম

৪। এমএইচটিটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম

৫। জার্মানির ডিএএডি

৬। অস্ট্রেলিয়ার ডেভেলপমেন্ট স্কলারশিপ

সেলফ ফান্ডিং

স্কলারশিপ বাদেও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে নিজস্ব ফান্ডিং ব্যবস্থা। এ বিষয়ে প্রফেসরের শরণাপন্ন হলে মিলবে সুযোগ। যারা এ ব্যয়ভার বহনে সামর্থ তাদের স্কলারশিপের ঝামেলা পোহানোর দরকার নেই। সেলফ ফান্ডিং এর আওতায় আপনি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে পারবেন।

আর্থিক সামর্থ্য বা সচ্ছলতার সনদ

দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইয়ের পর যখন আপনি ভিসা নিতে যাবেন তখন আপনার প্রয়োজন হবে আর্থিক সামর্থ্য বা সচ্ছলতার সনদ। যদি আপনি ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ পান, তাহলে আপনাকে ভ্রমণ, স্বাস্থ্য বীমা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানের প্রমাণ দিতে হবে। আর যদি সেলফ ফান্ডিং বা আংশিক বৃত্তি পান, তাহলে আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচসহ যাবতীয় খরচ নির্বাহের জন্য অর্থের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে। অন্যদিকে আপনি নিজে যদি আপনার নিকট আত্মীয়, যেমন- বাবা, মা, ভাই , বোন এই ব্যয়ভার বহন করেন তাহলে তার সম্মতিপত্র ও তার আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ দিতে হবে। এ জন্য ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিন) ও ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট, গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, যার মাধ্যমে আপনি আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কাগজপত্র পাঠাবেন যেভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ে কাগজপত্র পাঠানোর আগে প্রথমে জানতে হবে সেখানে এসব লাগবে কিনা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শুধু অনলাইন আবেদন চায়। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে অনলাইনে আবেদনের পাশাপাশি কাগজপত্রগুলোর হার্ড কপিও লাগে। এসব কাগজপত্র পাঠানোর জন্য আপনি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার হিসেবে ফেডএক্স বা ডিএইচএল ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও বাংলাদেশের সরকারি পোস্ট অফিসের ইএমএস সেবাও নিতে পারেন। কম খরচে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ পৌঁছে দেবে আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

এসএইচ-০৯/০৬/২২ (শিক্ষা ডেস্ক)