শরণার্থী থেকে বিশ্বসেরা অভিনেতা

জন্মসূত্রে মিশরীয়। বসবাসসূত্রে মার্কিন। বাবা–মা চাননি অভিনয় করুন। কিন্তু রামি মালেক তো অন্য কিছু চাননি। অস্কারজয়ীর জীবন নিয়ে লিখলেন উদ্দালক ভট্টাচার্য।

২০১৯ সালের অস্কার মঞ্চে সেরা অভিনেতার নামটা ঘোষিত হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে রামি মালেকের চোখটা বড়বড় হয়ে গিয়েছিল। মঞ্চে উঠলেন, পুরস্কার নিলেন, মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন ‘‌ওহ্‌, মাই গড!’‌ ঠিক যেন কুইনের আত্মভোলা শিল্পী ফ্রেডি মার্কারি।

রামি আমেরিকায় প্রথম প্রজন্মের নাগরিক। সইদ মালেক–নেলি আব্দেল মালেক মিশর ছেড়ে আমেরিকায় আসেন ১৯৭৮ সালে। তাঁদের সন্তান রামির জন্ম ১৯৮১ সালের ১২ মে। রামির পরিবার ছিল মিশরের আদি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অংশ। আশির দশকের শেষে তাঁরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। আমেরিকায় এসে রামির মা হিসাবরক্ষকের চাকরি নেন, বাবা বিমা সংস্থার হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। দেশ–সমাজ–সংস্কৃতি পাল্টালেও আগাগোড়া রামির রক্তে ছিল ভাষা ও মিশরের সংস্কৃতি।

‘স্কুলে কেউ আমার নাম ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারত না। কেমন বেমানান লাগত নিজেকে। হাইস্কুল পর্যন্ত সাহসই হয়নি কাউকে নামটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে বলার। পরে অবশ্য বলতে পেরেছিলাম’‌— একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রামি। জন্ম থেকে আমেরিকায় থাকলেও অন্তরের সংস্কৃতি তাঁকে প্রথমে সে দেশের সঙ্গে মিশতে দেয়নি। মা–বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে উকিল হবে। তাই ছোটবেলা থেকেই বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় অংশ নেওয়া।

কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার নত্রেদাম হাইস্কুলের শিক্ষকরা লক্ষ্য করেন, রামির আগ্রহ নাটকে। স্কুলেই শুরু অভিনয়শিক্ষা। ১৯৯৯ সালে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ। বিষয়? অভিনয়। সেই সময় থেকেই রামি ঠিক করে নেন, অভিনয় নিয়েই এগোতে চান। এভান্সভিল বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন।

যত দিন গেছে, অভিনয়ের নেশা তাঁকে জাপ্টে ধরেছে। কিন্তু মা–বাবা তো চান না!‌ তাই কলেজে পড়াকালীন নিজের নাটক দেখাতে একদিন নিয়ে এলেন দু’‌জনকে। সেদিন ‘‌জুমান অ্যান্ড দা সাইন’‌ নাটকে অভিনয় করবেন রামি। ‘‌প্রথমবার দেখলাম, বাবা–মা কাঁদছেন। বুঝেছিলাম, অভিনয়কে পেশা হিসাবে নিতে আর কোনও বাধা নেই।’‌

পড়াশোনা শেষে তৈরি করলেন থিয়েটারের দল। এদিক–ওদিক শো শুরু করলেন, কিন্তু উপার্জন তেমন হল না। একজন বললেন, হলিউডের প্রোডাকশন হাউসে যোগাযোগ করতে। কিন্তু কোথায় কাজ! দোরে দোরে ঘুরেও কাজ পাচ্ছিলেন না। শুরু করলেন পিৎজা ডেলিভারির চাকরি। ফাস্ট ফুডের দোকান খুললেন। তারপর একদিন সুযোগ এল।

ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রযোজনায় ২০০০ সালে শুরু হয়েছিল টিভি সিরিজ ‘‌গ্লিমর গার্ল’‌। সেখানে প্রথম সুযোগ পান রামি। তারপর একে একে আরও কাজ। ২০০৬ সালে রামি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিতে অভিনয় করেন— ‘‌নাইট অ্যাট দ্য মিউজিয়াম’‌। প্রশংসা জোটে, কিন্তু আজব সমস্যায় পড়েন তিনি।

যে মিশরীয় ফ্যারাওয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সবাই তাঁকে সেই ধরণের চরিত্রেই ডাকতে থাকেন। ২০১০ সালে ফক্স নেটওয়ার্ক প্রযোজিত ‘‌টোয়েন্টি ফোর’‌ টিভি সিরিজে এক আত্মঘাতী জঙ্গির চরিত্রে অভিনয় করার পরই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে নিজের এজেন্টকে নির্দেশ দেন, মধ্য এশিয়ার বাসিন্দাদের ছোট করে দেখানো হয়, এমন কোনও চরিত্র এলে পত্রপাঠ বিদায় করে দিতে। তখনও চোরাস্রোতের মতো তাঁর ভিতরে ভিতরে কাজ করছিল শরণার্থী পরিচয়।

২০১০ সালেই শেষের দিকে এইচবিও–র টিভি সিরিজ ‘‌দ্য পেসিফিক’–এ অভিনয় করতে শুরু করেন। সেই প্রথম, অন্যরকম চরিত্রে অভিনয় করে জোটে প্রশংসা। ডেকে নেন বিখ্যাত অভিনেতা–প্রযোজক টম হ্যাঙ্কস। জুলিয়া রবার্টস আর টম হ্যাঙ্কসের ছবি ‘‌ল্যারি ক্রাউন’–এ রামি অভিনয় করেন কলেজ ছাত্রের ভূমিকায়। বদলে যেতে থাকে জীবন। এরপর ‘‌টোয়ালাইট সাগা–২’, কোরিয়ান পরিচালক স্পিক লি–র ‘‌দা‌ সুইট ব্লাড জেসাস’‌ পরপর। এক এক রকমের চরিত্রে দেখা যেতে থাকে রামিকে।

২০১৫ সাল। ইউএসএ নেটওয়ার্ক চ্যানেলের টিভি সিরিজ ‘‌মিস্টার রোবট’‌–এর মূল চরিত্রের জন্য হন্যে হয়ে লোক খুঁজছিলেন আমেরিকানিবাসী তাঁরই মতো মিশরীয় উদ্বাস্তু, পরিচালক স্যাম ইসমাইল। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন রামিকে। সিরিজের মূল চরিত্রে অভিনয় করলেন রামি। স্বপ্নের যাত্রা শুরু হল তাঁর। এরপর ২০১৬ সালে ‘‌বাস্টার ম্যাল হার্ট’‌, ২০১৭ সালে ‘‌প্যাপিলন’‌ (‌১৯৭৩ সালের বিখ্যাত ক্লাসিক ছবির রিমেক)‌— তাঁর অভিনীত দুটি ছবিই দেখানো হল টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। আর সবশেষে ‘‌কুইন’‌–এর ফ্রেডি মার্কারির চরিত্র।

‘‌বোহেমিয়ান র‌্যাপসোডি’‌ সিনেমার ইতিহাসে তেমন উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে না, যদি না একইসঙ্গে রামি মালেকের নামটি উচ্চারিত হয়। কারণ, এই ছবির একমাত্র প্রাপ্তি তাঁর অভিনয়। অস্কার পুরস্কারের স্বীকৃতি নিয়ে এক ‘‌মধ্য এশিয়ার উদ্বাস্তু’‌ যখন অ্যাকাডেমির মঞ্চ থেকে নামছিলেন, তখন কী যে হল!‌

হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন প্রায়। তাঁকে ধরতে এগিয়ে এলেন বাকি অভ্যাগতরা। আয়লান কুর্দির কথা মনে পড়ছিল। সিরিয়ার শিশুটি হয়ত ওইভাবেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। আর ওঠেনি। আমেরিকা কী বুঝেছে, শরণার্থীরা উদ্বৃত্ত নন?‌ তাঁরা সম্পদ।

এসএইচ-০৫/১৪/১৯ (বিনোদন ডেস্ক)