রাঘববোয়ালরা ফেঁসে যাচ্ছেন পিয়াসাকাণ্ডে

পার্টির নামে বাসায় ডেকে মাদকের নেশায় বুঁদ করে গোপনে ভিকটিমের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কেবল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদই পাতেননি কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। আন্ডারওয়ার্ড কানেকশনের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন নিষিদ্ধ পর্নো ব্যবসার বিশাল সিন্ডিকেট। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারি শীর্ষ স্থানীয় চাকুরেসহ পিয়াসার প্রতারণার শিকারের তালিকায় দেশের বিভিন্ন শহরের শীর্ষপর্যায়ের ধনীর দুলালরাও রয়েছেন।

অঢেল টাকার নেশায় ব্ল্যাকমেইলিং ও মাদক ব্যবসার পাশাপাশি পিয়াসা যুক্ত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অস্ত্র কেনাবেচা ও স্বর্ণ-ডায়মন্ড চোরাচালান চক্রেও। কথিত মডেল, নায়ক-নায়িকা, সুন্দরী তরুণী ছাড়াও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই সিন্ডিকেটে জড়িত একাধিক স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অভিনব বিভিন্ন পন্থায় প্রতি চালানে কোটি কোটি টাকার ডায়মন্ড চালান পাচার করত চক্রটি।

আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে চোরাই পথে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি এনেও বিক্রি করতেন পিয়াসা। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা কোটি কোটি টাকা মূল্যের এসব গাড়ি বিক্রিতে তাকে সহায়তা করতেন বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানরা। গত রবিবার গুলশানের বারিধারা এলাকা থেকে পিয়াসাকে গ্রেপ্তারের পর কথিত এই মডেলের অন্ধকার জগতের অন্যতম সহযোগী মরিয়ম আক্তার মৌকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পিয়াসা-মৌ এখন পৃথক মাদক মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে।

পিয়াসার তথ্যে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে এই সিন্ডিকেটের প্রধান সমন্বয়ক শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান ও তার সহযোগী মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে পিস্তল-গুলি, মাদক, জাল রুপি, বিলাসবহুল ফেরারি গাড়িসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পিয়াসা ও মৌসহ অর্ধশতাধিক মডেলকে অনৈতিক ও প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন মিশু হাসান। তাদের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। কিনেছেন নামিদামি ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল সব গাড়ি। গত বুধবার রাজধানীর ভাটারা থানায় র‌্যাব বাদী হয়ে মিশু হাসান ও জিসানের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করে র‌্যাব।

এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় আরও একটি মামলা করেন একজন ভুক্তভোগী। মিশু হাসান ও জিসান এখন বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে রয়েছেন। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদের আদালত শুনানি শেষে মিশুর পৃথক তিন মামলায় ৯ দিন ও জিসানের পৃথক দুই মামলায় চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ভাটারা থানার পর্নোগ্রাফি, অস্ত্র, মাদকসহ অপর একটি মামলায় মিশুকে ১০ দিন করে মোট ৪০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন পুলিশ। শুনানি শেষে বিচারক পর্নোগ্রাফি মামলায় একদিন, অস্ত্র আইনের মামলায় পাঁচ দিন ও মাদক আইনের মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে ভাটারা থানার পর্নোগ্রাফি ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের পৃথক দুই মামলায় জিসানের ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে বিচারক পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় একদিন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার চারজনই তাদের অপরাধ সাম্রাজ্যের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। তাদের তথ্যে উঠে আসছে বিভিন্ন পরিচিত মুখ ও তথাকথিত সেলিব্রিটিদের নাম। সামনে চলে আসছে তাদের নানা অপকর্মের অজানা তথ্য। এ ছাড়া তাদের সেলফোনের কললিস্ট যাচাই করে অসংখ্য ভুক্তভোগী ক্লায়েন্টের তথ্য ছাড়াও পিয়াসা-মিশুর অপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ৫ শতাধিক নায়ক-নায়িকা, মডেল, দেশের বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, অভিজাত এলাকায় ক্লাব পরিচালনায় দায়িত্বরত ব্যক্তি, শীর্ষপর্যায়ের গাড়ি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী, কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, বখে যাওয়া ধনীর দুলালসহ একাধিক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর তথ্য এখন আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। যদিও চোরাই পথে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি এনেও বিক্রি, পর্নোগ্রাফি ও মাদকের জমজমাট বাণিজ্যের বিষয়ে মুখ খুললেও তারা আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে অস্ত্র ও ডায়মন্ড কারবারের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গ্রেপ্তারকৃতদের যে তথ্য দিচ্ছেন, তা সত্য হলে ফেঁসে যেতে পারেন রাঘববোয়ালরা। সম্প্রতি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে নায়িকা পরীমনি ও কথিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা এবং মডেল মৌ, মিশু হাসান, জিসানসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক আতঙ্কে রয়েছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পিয়াসী চক্রের ক্লায়েন্টই শুধু নয়, যারা তাদের অপকর্মের ইন্ধন জুুগিয়েছেন দ্রুত তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে অস্ত্র ও ডায়মন্ডের কারবার থেকে শুরু করে মাদকের জমজমাট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত পিয়াসা ও মিশু হাসান সিন্ডিকেট। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের নিজের মাদকের আসরে ডেকে গোপন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতেন তারা। আর মৌ ছিল তাদের অন্যতম সহযোগী। দেড় যুগ আগে ছিঁচকে ছিনতাইকারী অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে এখন বনে গেছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। মিশুর মাধ্যমে গাড়ি এনে বিক্রির মূল কাজটি করতেন পিয়াসা। চক্রটি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কনটেইনারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে এসব গাড়ি আনত। কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও পিয়াসা এসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের কাগজ তৈরি করে কৌশলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করতেন উচ্চদামে। পিয়াসা এ পর্যন্ত মার্সিডিস, মার্সিডিজ- মেব্যাক, মার্সিডিজ-বেঞ্জ জি ক্লাস, অডি, অডি আর-৮, ল্যাম্বারগিনি, মাজদা, বিএমডব্লিউ ও লেক্সাস-৫৭০ মডেলসহ বিলাসবহুল শতাধিক গাড়ি বিক্রি করেছেন।

পিয়াসা ও মিশু হাসান সিন্ডিকেট ফার্মের অন্তরালে গরুর পেটে মিয়ানমার রুট দিয়ে প্রতি চালানে শতকোটি টাকার ডায়মন্ড চালান আনতেন মূলত তাদের গডফাদার বিশিষ্ট এক স্বর্ণ ও ডায়মন্ড ব্যবসায়ী। তার হয়ে চোরাই পথে শত শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এসব ডায়মন্ড অস্বাভাবিক ছাড় দিয়ে তা বিক্রি করেন ওই ব্যবসায়ী। অধিক মুনাফার লোভে মালয়েশিয়ান গোল্ড কয়েন দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির লোগো খচিত জুয়েলারি বানিয়ে বিক্রি করেন তিনি। হাজার কোটি টাকার মালিক ওই ব্যবসায়ীর ঢাকাতে নিজের কোনো বাড়ি না থাকলেও ইন্ডিয়াতে তার ১০টির ওপরে বাড়ি রয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন-অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তার মডেল পিয়াসা ও মৌ রাতে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতেন। এমনকি ভিডিও করে রাখতেন। পরে সেসব ভিডিও ও ছবি ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠানোর হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন এবং মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পিয়াসাচক্রের আরও অনেক পরিচিত মুখের নাম বেরিয়ে আসছে, যা যাচাই-বাছাই চলছে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকা, বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করে থাকেন। পার্টিতে তারা অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য। এ ছাড়া তাদের অবৈধ ব্যবসার নানা তথ্য মিলেছে। তদন্তে দোষী প্রমাণ হলে প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে।

এসএইচ-১৩/০৬/২১ (বিনোদন ডেস্ক)