পরীমনিকাণ্ডে তদন্তের মুখে পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন

দেশজুড়ে এখন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ঢালিউডের চিত্রনায়িকা পরীমনি ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি গোলাম সাকলায়েনের সম্পর্ক। গত ১ আগস্ট এই পুলিশ কর্মকর্তার সরকারি বাসায় পরীমনি একসঙ্গে ১৮ ঘণ্টা কাটিয়েছেন বলে শুক্রবার রাতে গণমাধ্যমে খবর আসে। এরপরই এ নিয়ে পুলিশ বিভাগে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয় বিভিন্ন মহলে।

এ অবস্থার মধ্যেই পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনের বাসায় পরীমনির প্রবেশ ও নামার একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হয়। এরপরই গতকাল শনিবার দুপুরে গোলাম সাকলায়েনকে গোয়েন্দা পুলিশ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) পশ্চিমে পদায়িত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় গোলাম সাকলায়েন সাভারের বোট ক্লাবে পরীমনিকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তের তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন। এই তদন্ত কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় পরীমনির সঙ্গে এই পুলিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে ওঠে। এই সখ্য দিনের পর দিন আরও গভীর হয় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের এই সখ্য আর গোপন থাকল না। এর জেরেই গোলাম সাকলায়েনকে শনিবার গোয়েন্দা পুলিশের সব কার্যক্রম থেকে সরিয়ে বদলি করা হয় পিওএমএতে।

ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেছেন, বদলির আদেশের আগেই সাকলায়েনকে গোয়েন্দা পুলিশের সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়।

একাধিক সূত্রের দাবি, বোট ক্লাবের মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলাকালেই পরীমনির বাসায় একাধিকবার যাতায়াত করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন। এ সময় দুজনের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকে। তারা দুজন একসঙ্গে বিভিন্ন সময় গাড়িতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরাও করেছেন। এমনকি তারা একসঙ্গে ঢাকার অদূরে একটি রিসোর্টেও সময় কাটিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

দুজনের সম্পর্কের বিষয়টি পরীমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদেও স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনির সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপুও এ ব্যাপারে তথ্য দিয়েছেন। পরীমনির সঙ্গে সাকলায়েনের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিল বলেও জানা গেছে। তবে আমাদের সময়ের কাছে সোমবার রাতে পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন বিয়ের কথা অস্বীকার করেন। পরীমনিকে নিয়ে নিজের বাসায় ১৮ ঘণ্টা কাটানোর অভিযোগও অস্বীকার করেন।

আমাদের সময়ের হাতে আসা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা যায়, ১ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে পরীমনির সাদা রঙের হ্যারিয়ার গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫ ৯৬ ৫৩) নিয়ে গোলাম সাকলায়েনের রাজারবাগের অফিসার্স কলোনির মধুমতি ভবনের ৯/সি নম্বর সরকারি ফ্ল্যাটের বাসায় আসে।

প্রথমে সেই গাড়ি থেকে লাল রঙের টি-শার্ট পরে বের হন সাকলায়েন। সাদা রঙের একটি সিøপিং গাউন পরে নামেন নায়িকা পরীমনি। সেই রাতে সোয়া ২টায় ওই ভবন থেকে বের হন পরীমনি। তবে রাতে বের হওয়ার সময় পরীমনির পরনে ছিল কালো রঙের পোশাক আর সাকলায়েনের গায়ে সাদা টি-শার্ট। এই ভিডিও ফুটেজ এখন ভাইরাল।

পরীমনির গাড়িচালক নাজির হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজারবাগ পুলিশ কোয়ার্টারে পরীমনিকে গত ১ আগস্ট সকালে তিনি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার রাতে পরীমনির ফোন পেয়ে তাকে আনতে যান। এ ছাড়া তারা দুজনই গাড়ি চালাতে পারেন। তারা মাঝেমধ্যেই আমাকে রেখে নিজেরা ড্রাইভ করে হাতিরঝিলে ঘুরতে যেতেন। গাড়ি চালানো অবস্থায় তারা কোনো কথা বলতেন না। তবে গাড়িতে মদ্যপান করতেন। আবার মাঝেমধ্যে তারা একা গাড়ি নিয়ে বের হতেন। এমনকি গত কোরবানি ঈদের সময় পরীমনির বাসায় পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন তিন দিন ছিলেন বলেও খবর চাউর হয়েছে।

পরীমনি ও পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে শনিবার সকালে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে কথা বলেন সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক। এ সময় সাংবাদিকরা তার কাছে প্রশ্ন করেন- বোট ক্লাবের শ্লীলতাহানি চেষ্টার মামলার বাদী পরীমনির সঙ্গে ১৮ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন, এটা তদন্তে উঠে আসবে কিনা?

উত্তরে শেখ ওমর ফারুক বলেন, ‘আমরা থ্রোলি তদন্ত করব। এই বিষয়টি আমাদের তদন্তে থাকবে। আমরা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যা পাব এবং মিডিয়াতে যা এসেছে সব নিয়েই তদন্ত করব। কেউ তদন্ত কর্মকর্তা হোক আর অন্য কেউ হোক, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যেটি সত্যি সেটি উদঘাটন করা হবে।’

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করে দেবেন। অবশ্য ঢাকার পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গত রাতে আমাদের সময়কে বলেন, আইজিপি মহোদয়ের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে দেবে।

সূত্র বলেছে, পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন বিবাহিত এবং তার স্ত্রী প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলায় কর্মরত আছেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে। শুক্রবার রাতে গোলাম সাকলায়েন ও পরীমনির গভীর সম্পর্কের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর থেকেই তারও মন খারাপ। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ৩০তম ব্যাচের কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন তার ব্যাচের মেধাক্রম অনুযায়ী প্রথম কর্মকর্তা।

পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, পরীমনির সঙ্গে গোলাম সাকলায়েনের সম্পর্কের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তারা চরম বিব্রত ও লজ্জিত। এ ঘটনা পুলিশ বাহিনীর ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। তারা এও বলছেন, মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা হিসেবে গোলাম সাকলায়েন যে কাজটি করেছেন তা নৈতিকভাবে করতে পারেন না। এতে প্রশ্নের জন্ম দেবে, এটাই স্বাভাবিক।

একাধিক সূত্র বলেছে, পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন নিজেকে অবিবাহিত দাবি করেই পরীমনির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তাদের এই সম্পর্ক বিয়ে করার আলোচনা পর্যায়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরীমনি যখন জানতে পারেন এই পুলিশ কর্মকর্তা বিবাহিত এবং তার সন্তান রয়েছে তখনই পরীমনি বেঁকে বসেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়।

জানা গেছে, গত ১৩ জুন ঢাকা বোট ক্লাবে গিয়ে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ করেন চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমনি। এর পরদিনই উত্তরার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদকে। পরে এই ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ পরীমনিকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন থেকেই গোলাম সাকলায়েন সঙ্গে পরিচয় হয় পরীমনির। এরপর থেকেই শুরু হয় যোগাযোগ। সখ্য। তারা নিয়মিত কথা বলতেন। নিয়মিত গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরুতেন। এমনকি সাকলায়েন তার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। কিন্তু তাদের এই সম্পর্কের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত গোপন থাকেনি।

এসএইচ-০৬/০৮/২১ (বিনোদন ডেস্ক)