দীর্ঘ ২৬ বছর পর অভিমান ভেঙে বাড়ি ফিরলেন!

যৌবনে যে মানুষটি স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান, সে মানুষটি বৃদ্ধ বয়সে সামাজিক সংগঠন ‘সহায়’ এর তত্ত্বাবধানে অবশেষে বাড়ি ফিরেছেন। মাঝের ২৬টি বছর কেটেছে অনাদর অবহেলা আর বঞ্চনার বাস্তব গল্পে। কখনো বা দিনমজুরের কাজ, কখনোবা ভিক্ষাবৃত্তি।

এভাবে জীবন সায়হ্নে এসে পড়া চাঁন মিয়া অবশেষে যখন বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়ছিলেন, তখন ফেনীর সামাজিক সংগঠন সহায়-এর কোলে মাথা গুঁজে প্রাণ রক্ষা পায়। চাঁন মিয়ার এই বাস্তব কাহিনী গল্পকেও হার মানিয়েছে।

পুরো নাম মুকমুল ইসলাম চাঁন মিয়া। ১৯৯৬ সালে স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর বাস স্টেশন, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্কুল বারান্দায় তার রাত কাটে। আধপেটা, আধাবেলা খেয়ে না খেয়ে কোন রকম জীবনের ২৬ বছর চালিয়ে দেন। অভিমানের কাছে হার না মানা চাঁন মিয়া অবশেষে রোগে শোকে আক্রান্ত বার্ধক্যের কাছে হার মেনে বাড়ি ফিরেছেন।

গত ১০ ডিসেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা থেকে চাঁন মিয়াকে অচেতন অবস্থায় স্থানীয়রা পুলিশের সহযোগিতায় উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

সেখানে ফেনীর সামাজিক সংগঠন ‘সহায়’ এর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। একই সঙ্গে তার পরিচর্যার কাজ শুরু করে সহায়। পাশাপাশি তার পরিচয় শনাক্তের জন্য কাজ করে সহায়। একই সঙ্গে চাঁন মিয়ার ছবি এবং তথ্য চেয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে এবং শেরপুরের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়।

অভিমানি চাঁন মিয়ার ছিল না কোনো জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র, সেই কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কোনো পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি।

গত ১৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ফেসবুকের একটি পোস্ট নজরে আসে চাঁন মিয়ার স্বজনদের। তখন সহায়ের টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন স্বজনরা। ভিডিও কলের মাধ্যমে স্বজনরা চাঁন মিয়ার পরিচয় শনাক্ত করে। বার্ধক্যজনিত নানান রোগে আক্রান্ত চাঁন মিয়া ফেনী জেনারেল হাসপাতালে দীর্ঘ এক মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন।

১৫ জানুয়ারি শনিবার দীর্ঘ ২৬ বছর পর ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল চিকিৎসাধীন থাকার পর তার পরিবারের কাছে ফিরলেন। শনিবার সকালে তার পরিবারের লোকজন এসে তাকে নিয়ে যায়।

চাঁন মিয়ার ছোট ভাই ব্যবসায়ী শাজাহান জানান, তার ভাই মুকমুল ইসলাম চাঁন মিয়া তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। বাবার নাম মহিদুল ইসলাম এবং মায়ের নাম অম্বিয়া খাতুন। শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গৌরীপুর ইউনিয়নের খাজুরিয়া পাড়ার মণ্ডল বাড়ির বাসিন্দা তারা।

গত ২৬ বছর ধরে তার ভাইকে দেশের বিভিন্ন স্থানে খুঁজেও তাকে পায়নি। চাঁন মিয়ার ছোট মেয়ে জানান, তারা দুই বোন ও এক ভাই, ১৯৯৬ সালে যখন তার বাবা মায়ের সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয় তার কিছু দিন পর তার মা রিক্তা শেরপুরের ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক হিসেবে একটি সরকারি চাকরি পান। মায়ের উপার্জন দিয়ে তাদের পরিবার চলত। গত দুই বছর মা রিক্তা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে বিছানায় শুয়ে আছেন।

তিনি অরও জানান, ফেনীর সামাজিক সংগঠন ‘সহায়’ এর ফেসবুক পেজে গত ১৩ জানুয়ারি তার বাবার ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করতে পারেন। পরে মোবাইল ফোনে বাবার সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে নিশ্চিত হন চাঁন মিয়া বেঁচে আছেন।

ফেনীর সামাজিক সংগঠন সহায়ের প্রধান সমন্বয়ক মঞ্জিলা মিমি বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর সকালে অসুস্থ অবস্থায় ছাগলনাইয়া থেকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর থেকে চাঁন মিয়া স্ত্রীর সঙ্গে অভিমানের জেরকে বহাল রেখে তার পরিবারের সদস্য ও তার বাড়ির ঠিকানা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

এরপরে তার দেওয়া আংশিক তথ্য দিয়ে সংগঠনের সহসভাপতি জুলহাস তালুকদার শেরপুরের বিভিন্ন স্যোসাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের খোঁজ নেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ের তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় এবং তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ইকবাল হোসেন জানান, চাঁন মিয়া বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ ও মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ায় বর্তমানে তিনি কিছুটা সুস্থ আছেন।

এসএইচ-০২/১৬/২২ (অনলাইন ডেস্ক)