ছাত্রলীগ ও যুবলীগের তৈরী ‘টর্চার সেল’

বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের নির্যাতন এমনকি টর্চার সেল গড়ে তোলার কথা জানা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে যুবলীগের নেতাদের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পাওয়া গেছে নির্যাতনের জন্য টর্চার সেলের অস্তিত্ব।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের মধ্যে এই টর্চার সেল বা নির্যাতনের একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলে চলছে সমালোচনা।

বুয়েটের হলে থাকা এক ছাত্র জানিয়েছেন, তাকেও শিবির সন্দেহে রাতভর দফায় দফায় পেটানো হয়েছিল। কিন্তু ভয়ে আতঙ্কে বিষয়টি গোপন করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ছাত্র বলেন নির্মম ভাবে তাকে পেটানো হয়G

“আমি আমার এলাকার এক নেতার দুর্নীতি আর ব্যাংকের অর্থ চুরির খবর ফেসবুকে দিয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার অপরাধ।”

“রাতে রুমে দশ বারোজন এসে আমাকে জেরা করে। বলে আমি শিবির কিনা! প্রথমে চড় মারে। এরপর স্ট্যাম্প দিয়ে মারে। আমার পেছনে মারছিল পায়ে মারছিল। ধরেন রাত ১২টা থেকে ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত এভাবে চলেছে।”

ভুক্তভোগী ছাত্ররা বলছেন, সরকারের সমালোচনা, অন্যায়ের প্রতিবাদ বা দুর্নীতি অনিয়মের খবর কেউ ফেসবুকে প্রচার করলেই সে ছাত্রলীগের জেরার নামে নির্যাতনের টার্গেট হয়েছেন।

তুচ্ছ অপরাধেও নানারকম হয়রানি আর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বহু ছাত্রকে। এমনকি প্রতিবাদ করলে ছাত্রলীগের হল শাখার নেতারাও আক্রান্ত হয়েছেন।

ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অপসারণ এবং আবরার ফাহাদের ঘটনার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্যাতনের শিকার ছাত্রদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে আসছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্বের কমিটির হল শাখার একজন পদধারী নেতা জানান, ফেসবুকে একটা পোস্টের কারণে তাকে যিনি নির্যাতন করেন তার দখলে থাকা রুমটি সিলগালা করে দিয়েছে হল প্রশাসন।

“আমাকে চড়থাপ্পড় মারা হয়। পিস্তল মাথায় ঠেকিয়েছিল। কিন্তু মারে নাই। আমিও অনেক ভয় পেয়েছিলাম। এদের কারণেই ছাত্রলীগের দুর্নাম।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মশিউর রহমান জানান, প্রথম বর্ষেই ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যোগ দেয়ার পর তাকে পিটিয়ে আহত করে পুলিশে দেয়া হয়। এরপর থেকে হল ছাড়া হয়েছেন তিনি।

“আপনি একটু ভিন্নমতের হলে আপনাকে প্রথম যেটা বলা হবে যে আপনি শিবির! এই শিবির বলে নির্যাতন করা হয়। আর শিবির বলার পর আর কেউ কোনো কথা বলার সাহস পায় না।”

শুধু বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের হাতে এমন নির্যাতনের একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছ বলেই অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে শুধু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনই নয়, নির্যাতন বা টর্চার সেল সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে সরকারি দলের যুব সংগঠনেও।

সম্প্রতি ঢাকায় র‍্যাবের অভিযানে যুবলীগ নেতাদের অফিসে অবৈধ অস্ত্র ছাড়াও নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত সরঞ্জামের সঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেয়ার মেশিন পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে।

অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগের এক নেতার মাধ্যমে একজন ভুক্তভোগী জানান, রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে আইন আদালত, পুলিশ প্রশাসন কিছুই তোয়াক্কা করতেন না যুবলীগের আটক নেতা। বেআইনিভাবে তার সম্পত্তি আরেকজনকে দখল করে দিয়েছেন যুবলীগের আটক নেতা।

যুবলীগ নেতার অফিসে কয়েকবার ডেকে নেয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে এই ভুক্তভোগীর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ ব্যক্তি জানান, তাকে শারীরিক নির্যাতন না করলেও মানসিক নির্যাতনের শিকার তিনি।

“একাধিকবার আমাকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে যায় এবং সরাসরি আমাকে বলে দেয় কোনো কিছু করে কোনো লাভ হবে না।”

“যদি আপনি আইনের আশ্রয় নেন পুলিশের কাছে যান আপনার আরো ভয়ানক পরিস্থিতি হবে। এ এলাকার সর্বেসর্বা বলতে তাকেই বোঝাতো। সেটাকে মাফিয়া নাম দিবেন না ডন নাম দিবেন বা সন্ত্রাসী নাম দিবেন সেটা আপনারাই ভাল বোঝেন”!

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র এবং যুব সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে এমন নির্যাতনের সংস্কৃতি জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলেন বিষয়টি শঙ্কার।

“এই অল্প তরুণ বয়সে তারা কেন এমন নির্দয় নিষ্ঠুর ভূমিকা পালন করবে। আমার মনে হয় আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এটা থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে।”

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রলীগের টর্চার সেল বা নির্যাতনকারীদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখছে ছাত্রলীগ।

আর অভিযানে আটক হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে যুবলীগ তাদের বহিষ্কার করছে।

সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, এসব ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং ছাত্রলীগের মধ্যে অনেকে এসব নিয়ে বিব্রত।

কিন্তু প্রশ্ন হলো ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় এরা কি প্রশ্রয় পেয়েছে?

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ বলেন, “যখনই কোনো ছাত্র বা যুবলীগ বা যেকোনো সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমরা কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেইনি।”

ক্ষমতাসীন দল দায় এড়াতে চাইলেও অনেকের প্রশ্ন তাহলে এই যে নির্যাতন আর টর্চার সেলের সংস্কৃতি কিভাবে গড়ে উঠলো?

শীপা হাফিজ বলেন, দুর্বলের ওপর শক্তিমানের নির্যাতনের ঘটনা সবক্ষেত্রেই বেড়েছে।

“মুখে বলা হচ্ছে আমরা সমর্থন করি না কিন্তু এটা বন্ধ করার জন্য যদি কোনো ব্যবস্থা না দেখি আমরা মনে করি যে সমর্থনই করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশ এভাবে টিকতে পারে না বাঁচতে পারে না।

এসএইচ-০৫/২১/১৯ (আবুল কালাম আজাদ, বিবিসি)