২০২০ সাল বিভ্রান্তির করোনা বছর!

এক বছর ধরে করোনা নিয়ে বহু বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। একেবারে গোড়ার দিকে অসুখটি নিয়ে বহু ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমে।

চীনের মধ্য হুবেই প্রদেশে ভাইরাল নিউমোনিয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখনো পর্যন্ত ২৭ আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। চীনের চিকিৎসাকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।’ বিশ্ব জোড়া প্যানডেমিক তখনো অজানা। করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে এটাই ছিল ডিডাব্লিউয়ের প্রথম খবর। এক বছর আগে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথমবার প্যানডেমিক সংক্রান্ত খবর ডিডাব্লিউতে প্রকাশিত হয়েছিল। করোনা, প্যানডেমিক শব্দগুলি অবশ্য তখনো সামনে আসেনি।

৯ জানুয়ারি প্রথম করোনা ভাইরাস শব্দটি জানা যায়। তবে তার আগে ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত নিউমোনিয়া সংক্রান্ত অসংখ্য খবর লেখা হয়েছিল। বলা হয়েছিল চীনে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ বাড়ছে। জার্মানিতে প্রথম করোনা ধরা পড়ে ২৮ জানুয়ারি। তখনো রোগটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিও তখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। আইসোলেশন ছিল একমাত্র চিকিৎসা।

ছোঁয়াচে নয়

উহানের বিশেষজ্ঞরা ডিসেম্বর মাস থেকেই রোগটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছিলেন। ২৭ জন যখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, তখন উহানের বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, মানুষের থেকে মানুষের শরীরে এই রোগ সংক্রমিত হয় না। মাছ থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। বস্তুত, উহানের মাছ এবং পশু বাজার থেকে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে বলে মনে করা হয়েছিল। মানুষের থেকে মানুষের শরীরে যে এই রোগ সংক্রমিত হয় না, সে খবর করেছিলাম আমরা।

পরে কী হলো

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) সরকারি ভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে ৫ জানুয়ারি। সেখানে বলা হয় এক অজানা নিউমোনিয়ার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। চীনের গবেষকরা বলছেন, মানুষের থেকে মানুষের শরীরে এর সংক্রমণ ঘটছে না। অর্থাৎ, সেই অর্থে রোগটি ছোঁয়াচে নয়। তবে মাছের থেকে সংক্রমণ ঘটতে পারে।

৯ জানুয়ারি অবশ্য ডাব্লিউএইচও দাবি করে, করোনা ভাইরাস পরিবারের নতুন একটি ভাইরাস এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এটি মানুষের থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। তবে হবেই, এমন বলা যাচ্ছে না। এই ভাইরাস শরীরে ঢুকলে ভয়াবহ অসুস্থতা হতে পারে। মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। রোগীর সংখ্যাও লাফিয়ে বা়তে শুরু করে। প্রথম দিকে প্রতি সাত থেকে আট দিনে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছিল।

২০ জানুয়ারি চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন জানায়, ভাইরাসটি এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে সংক্রমিত হচ্ছে। এর প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণ গুয়াংডঙে দুই জনের শরীরে ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, পরিবারের অন্যরাও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মাধ্যমেই ওই দুইজনের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। ২৪ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের জার্নাল ল্যানসেটে প্রথম বলা হয়, ভাইরাসটির টেস্ট হওয়া দরকার। কারণ, এই ভাইরাস প্যানডেমিকের চেহারা নিতে পারে।

সার্স নয়

৫ জানুয়ারি চীনের প্রশাসন জানায়, নতুন অসুখ সার্স নয়। ২০০৩ সালে এই সার্সেই মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের। ডিসেম্বরের শেষের দিকে একটি পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে চীনের প্রশাসন এই তথ্য দিয়েছিল। পরে দেখা যায়, রিপোর্টটি ভুল।

২০০০ সালে যে সার্সের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল, তার সঙ্গে পুরোপুরি না মিললেও, এই ভাইরাসটিও যে সার্স পরিবারের তা বুঝতে খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। ৭ জানুয়ারি প্রথম সরকারি ভাবে নতুন ভাইরাসটির নাম ঘোষণা হয়– নোবেল করোনা ভাইরাস, ২০১৯।

এর কিছু দিনের মধ্যেই চীনের গবেষকরা নতুন ভাইরাসের জিন কাঠামো প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, ২০০২-০৩ সালে যে সার্সের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, জিন কাঠামোর দিক থেকে নতুন ভাইরাসের সঙ্গে তার প্রচুর মিল। সে সময়েই এডিবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যানড্রিউ রামবৌট হিসেব করে দেখিয়েছিলেন, সার্সের সঙ্গে নতুন ভাইরাসের ৮৯ শতাংশ মিল রয়েছে।

১১ ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি অফ ভাইরাসেস প্রথম নতুন ভাইরাসটিকে সার্স বলে চিহ্নিত করেন। নতুন ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রম করোনা ভাইরাস ২। আগের সার্সের সঙ্গে নতুন ভাইরাসের তফাত হলো, সার্স ফুসফুসে আরো ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটায়। কিন্তু নতুন ভাইরাসের মতো দ্রুত সমাজে ছড়িয়ে পড়ে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সময় থেকে নতুন ভাইরাসকে সংক্ষেপে কোভিড ১৯ ভাইরাস বলে সম্বোধন করতে শুরু করে।

উহানের কড়া লকডাউন

২২ জানুয়ারি উহানে প্রথম লকডাউন ঘোষণা হয়। প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ উহানে থাকেন। তাঁদের বাড়ি থেকে বেরনো কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। দোকান বাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়।

৭৬ দিন এ ভাবে লকডাউনের মধ্যে কাটিয়েছে উহান। কিছু দিনের মধ্যেই হুবেই প্রদেশের অন্য শহরগুলিতেও একই কাজ করা হয়।

গোটা এলাকায় ১৪ হাজার হেলথ চেকপয়েন্ট তৈরি করা হয়। শীতের ছুটি শেষ হয়ে গেলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়নি।

প্রথম দিকে মানুষজন বাড়ির বাইরে বেরতে পারছিলেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই দিনে একবার খুব প্রয়োজন হলে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার নিয়ম ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনলাইনে অর্ডার দিতে হচ্ছিল। প্রশাসন ঘরে ঘরে গিয়ে চেকআপ করতে শুরু করে। কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে জোর করে আইসোলেশনে পাঠানো শুরু হয়।

অনেকেই সে সময় বলেছিলেন, পশ্চিমা দেশে এমন লকডাউন কল্পনাও করা যায় না। একমাত্র একনায়কতান্ত্রিক দেশেই এমনটা সম্ভব।

উহানের লকডাউনে কাজ হয়েছিল। এক বছরের মধ্যে শহরটি প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে পেরেছে। নাটকীয় ভাবে সেখানে করোনার প্রকোপ কমেছে।

উহানের করোনা কমেছে। বেড়েছে ইটালিতে। উত্তর ইটালিতে করোনা ছড়াতে শুরু করে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। ইটালির প্রশাসন উহান স্টাইল লকডাউন ঘোষণা করে সে দেশেও। লোম্বার্ডি এবং ভেনেটোর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আইসোলেশনে চলে যান। সংক্রমণ বাড়তে থাকে। লকডাউনও আরো কড়া হয়। তবে উহানের মতো নিয়ম ইটালিতে কেউ মানেননি। তার ফলও ভুগতে হয়েছে।

ইটালিতে যখন করোনা ছড়াতে শুরু করেছে তখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এমার্জেন্সি ঘোষণার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি। ২৩ জানুয়ারি এই বিবৃতি প্রকাশ করেছিল ডাব্লিউএইচও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই ঘোষণার সময়েও মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ এর নীচে ছিল। কিন্তু এর কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যুর পরিমাণ লাফিয়ে বাড়তে থাকে।

৩০ জানুয়ারি ডাব্লিউএইচও ফের বৈঠকে বসে। সেখানে বলা হয়, এর আগে ভাইরাসটিকে যতটা সহজ বলে মনে হচ্ছিল, ভাইরাসটি ততটা সহজ নয়। মানুষের থেকে মানুষের শরীরে দ্রুত ছড়াচ্ছে রোগ। এবং তা চীনের বাইরে ছড়াতে শুরু করেছে। এই বৈঠকেই প্রথম এমার্জেন্সি ঘোষমা করা হয়।

বিবৃতিতে ডাব্লিউএইচও প্রধান স্পষ্ট জানান, জার্মানি, ভিয়েতনাম, জাপানে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এমার্জেন্সি ঘোষণার পিছনে অন্য কারণ ছিল। অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলিতে ভাইরাস যাতে ছড়াতে না পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল।

১১ ফেব্রুয়ারি ডাব্লিউএইচও ভাইরাসটিকে মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু বলে ব্যাখ্যা করে।

বাভারিয়া থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম

আমরা রিপোর্ট করেছিলাম যে, বাভারিয়া থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। ২৮ জানুয়ারি ডিডাব্লিউ প্রথম জার্মানিতে করোনার কেস রিপোর্ট করে। প্রথম কেসটি বাভারিয়াতেই হয়েছিল। এরপরের দুইটি কেসও বাভারিয়ায়। তবে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মিউনিখে একটি সংস্থার ওয়ার্কশপে চীনের এক নারী এসেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই করোনা ছড়িয়েছে। তবে বাভারিয়ায় রোগটি ছড়ানোর সম্ভাবনা কম বলেই মনে করা হয়েছিল।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জার্মানিতে ১৬ জনের শরীরে করোনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে ১৪ জনই বাভারিয়ার। এই সময় থেকেই জার্মানিতে টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সামান্য অসুস্থ হলেই তাঁকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য দফতর খুব ভালো কাজ করতে শুরু করে।

কিন্তু এই সময়ে ইউরোপে দ্রুত ছড়াতে শুরু করে করোনা। এবং শেষ পর্যন্ত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে প্যানডেমিক বলে ঘোষণা করে।

উত্তর ইটালি থেকে আসা মানুষদের মাধ্যমে জার্মানির বিভিন্ন এলাকায় করোনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে। ৯ মার্চ জার্মানিতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর পরেই লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয় জার্মানি।

করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রাথমিক স্তরে প্রচুর ভুয়ো খবর ছড়িয়েছিল। তথ্য কার্যত কিছু ছিল না। এক বছর পর সে দিকে তাকালে অবাকই লাগে। কী ভাবে প্যানডেমিক নিয়ে কেটে গিয়েছে এক বছর। কী ভাবে একটু একটু করে জানা গিয়েছে নতুন ভাইরাস সম্পর্কে।

এসএইচ-০৭/৩১/২০ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র : ডয়চে ভেলে)