ইভ্যালি নিয়ে শুধুই আওয়াজ, তদন্তে অগ্রগতি নেই

কথিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে ইভ্যালি নিয়ে ব্যাপক হইচই এবং রাসেল ও তার স্ত্রী গ্রেপ্তার হলেও তদন্তে অগ্রগতি নেই। আদালতের বার বার তাগাদা সত্ত্বেও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়া হয়নি।

এরই মধ্যে ইভ্যালি সংক্রান্ত নতুন এক মামলায় অভিনেতা তাহসান রহমান খান এবং অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা ও শবনম ফারিয়াকে আসামি করায় তা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। মিথিলা এবং শবনম ফারিয়াকে সোমবার হাইকোর্ট ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন। তাহসান দেশের বাইরে আছেন। ইভ্যালির একজন ভোক্তা স্যাম রহমান গত ৪ ডিসেম্বর মামলাটি করেন।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল এবং তার স্ত্রী ও এমডি শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব ও পুলিশ। আরিফ নামে একজন গ্রাহকের মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই গ্রাহক গুলশান থানায় তিন লাখ ১০ হাজার ৫৯৭ টাকার প্রতারণার মামলা করেন। এরপর ঢাকাসহ সারাদেশে আরো অনেক মামলা হয়। সব মামলায় অভিযোগ একই রকম। নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য না দিতে পারলে দ্বিগুণ টাকার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও পণ্য এবং টাকা কোনোটিই না দেওয়ার অভিযোগই এসব মামলায় বেশি।

গুলশান থানার মামলায় তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকার চিফ অ্যাডিশনাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূর গুলশান থানাকে ২১ অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। ওই আদালতের জিআরও এসআই আলমগীর হোসেন জানান, “নির্ধারিত তারিখে তো নয়ই, এখন পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়নি। তারিখের পর তারিখ পড়ছে।”

প্রথমে মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন গুলশান থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, “আদালত আমাকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছে বলে আমার জানা নাই। আর বলে থাকলেও আমি মামলার তদন্ত করেছি মাত্র সাত দিন। এরপর মামলা সিআইডিতে চলে যায়।”

ওই সময়ে তদন্তে কী পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,”মামলা হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আমরা রাসেল ও শামীমাকে গ্রেপ্তার করেছি। আর প্রতারণার কিছু তথ্য পেয়েছি। তবে তারা কী পরিমাণ টাকা এবং কত গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তা আমরা জানতে পারিনি।”

তিনি বলেন,”তাদের প্রতারণার কৌশল ছিল কম দামে পণ্য দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ হতিয়ে নেয়া। লেনদেন হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আর আমরা মাত্র সাত দিন তদন্ত করেছি। মামলা আমাদের হাত থেকে সিআইডিতে যাওয়ার পর আমাদের কাছে নতুন কেউ অভিযোগও নিয়ে আসেনি। ইভ্যালির অফিস ধানমন্ডিতে। ওই থানায় কেউ গিয়ে থাকতে পারে।”

সিআইডি থেকেও মামলার তদন্তের তেমন কোনো অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) হুমায়ুন কবির জানান,”আমরা মূলত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে মানি লন্ডারিং মামলা হয়েছে সেগুলো দেখছি। আরো কিছু অভিযোগও আছে। ইভ্যালির প্রতারণার মামলা তো আমাদের কাছে নাই। আমরা তাদের ভার্চুয়াল কার্ডের বিষয়টি তদন্ত করছি। এখনো তদন্ত পর্যায়ে আছে।” তিনি বলেন,”আমরা সরাসরি মামলার বাইরেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেও কিছু অভিযোগ তদন্ত করছি। সবই তদন্ত পর্যায়ে তাই এর বেশি কিছু বলা যাবে না।”

জানা গেছে সিআইডি এখন মোট ১৩টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তদন্ত করছে।

ইভ্যালির সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠানটি সচল করতে একটি পরিচালনা পর্যদ গঠন করে দিয়েছেন গত অক্টোবর মাসে। পর্ষদের চেয়ারম্যান হলেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। গত ২৩ নভেম্বরের মধ্যে তাদের একটি প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিলো আদালতে।

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান,”আমাদের তদন্ত আমরা এখনো শেষ করতে পারিনি। ৭-৮টি ব্যাংকের হিসাব নিয়েছি, তেমন কোনো টাকা নেই। আমাদের প্রবল সন্দেহ দেশের বাইরে টাকা পাচার হয়েছে। তাই সেটা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সহায়তা চেয়েছি।”

তারা এখন ইভ্যালির অফিসেই বসছেন। সেখানে হাজার হাজার কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সিন্দুকটি এখনো খোলা যায়নি। আদালতের মাধ্যমে রাসেলের কাছে চাবি চাওয়া হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, চাবি আছে বাড়ির মালিকের কাছে। কিন্তু মালিক সালাহউদ্দিনও চাবি দেয়নি। তার বিরুদ্ধে মামলা করার পর র‌্যাব তাকে কয়েকদিন আগে গ্রেপ্তার করেছে। সে অনেক ডকুমেন্ট সরিয়ে ফেলেছে বলে জানান শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি জানান,”ইভ্যালির সাথে আমাজনের ব্যবসা ছিলো। তাদের তথ্য সুরক্ষিত আছে। কিন্তু সেই তথ্য এখনো আমরা নিতে পারিনি।”

বিচারপতি মানিক জানান,”বাড়ির মালিক সালাহউদ্দিন জানিয়েছেন রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিমাসে দুবাই যেতেন। তারা টাকা পাচারের উদ্দেশ্যেই যেতেন বলে সন্দেহ করি।”

পরিচালনা পর্ষদ গ্রাহকদের তথ্যও সংগ্রহ করে রাখছে। তাদের ছয় মাসের আগে কোনো টাকা দেয়া হবে না। তবে আদালত গেটওয়ের কয়েক কোটি টাকা গ্রাহকদের দিতে বলেছেন। ওই টাকা আছে এবং তা দেয়া হবে বলে জানান বিচারপতি মানিক।

এদিকে বাংলাদেশ ই-কমার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসান দাবি করেন,”রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করার পর তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। পরিচালনা পর্ষদও গ্রাহকদের সাথে কথা বলছেন না। গ্রাহক, ভেন্ডর কেউই সরকারের এই পদক্ষেপে লাভবান হচ্ছেন না।”

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এর আগে জানিয়েছে, গ্রাহকেরাই ইভ্যালির কাছে ৫৪৪ কোটি টাকা পাবেন।

এসএইচ-১৮/১৩/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)