জমিজমা নিয়ে বিরোধ আর মামলা-মোকদ্দমা বেশী!

দেশে এই মূহুর্তে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখের মত, আর এসব মামলার বড় অংশটি অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ মামলা জমিজমা সংক্রান্ত নানা ধরণের বিরোধের সূত্রে দায়ের করা।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেওয়ানি এবং ফৌজদারি আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেওয়ানি এবং ফৌজদারি উভয় মামলার বেলাতেই দেখা যায় জমিজমার অংশীদারিত্ব ও বণ্টন এবং এ নিয়ে পারিবারিক বিরোধের সূত্র ধরে নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ দায়ের হয় মোকদ্দমা।

এসব মামলা অনেক ক্ষেত্রেই চলে বছরের পর বছর ধরে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বিবিসিকে বলেছেন, “বিচারাধীন মামলার ৬০ শতাংশের বেশিই জমিজমা সংক্রান্ত। অধিকাংশ মামলার ‘রুট’ হচ্ছে জমি নিয়ে।”

স্থানীয় পর্যায়ে সমস্যা এতটাই প্রকট যে কয়েকদিন আগে দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে জেলা প্রশাসকদের বার্ষিক সম্মেলন, যেখানে কোভিড-১৯ মহামারি ব্যবস্থাপনাসহ আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে অন্যতম বিষয় ছিল ভূমি ব্যবস্থাপনা।

কিন্তু কেন জমিজমা নিয়ে এত বিরোধ আর মামলা-মোকদ্দমার ঘটনা ঘটে?

জমিজমা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয় পরিবারের সদস্য এবং শরিকদের বিরুদ্ধে। এ ধরণের বিরোধের পেছনে প্রধান কারণ থাকে জমির বণ্টন সংক্রান্ত বিবাদ।

অনেক সময়ই দেখা যায়, জমির মালিকের মৃত্যুর পর, তার ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তির বণ্টন যথাযথ বা দাবিমত না হলে, কিংবা আইনসিদ্ধ না হলে বিরোধের সূত্রপাত্র ঘটে।

আর তা থেকেই দেখা যায়, সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাটেয়ারা মামলা এমন ধরণের মামলা হয়।

পারিবারিক বিরোধের জের ধরে মারামারি, দখল, হত্যা, অপহরণ কিংবা ধর্ষণের মত গুরুতর ফৌজদারি অপরাধও ঘটে।

অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেছেন, জমিজমা নিয়ে যত মামলা হয় তার ৬০ শতাংশ হয় শরিকদের মালিকানা বা উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।

আর সেটি বেশিরভাগ হয় পরিবারের মেয়ে সদস্যদের জমির ভাগ ঠিকমত বুঝিয়ে না দেবার কারণে।

তিনি বলেন, “এক সময় গ্রামে পরিবারে মেয়েরা জমির ভাগ নিত না, এটা একটা কমন প্র্যাকটিস ছিল। কিন্তু জমির দাম উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ার পর দেখা মেয়ের দিকের সন্তান বা তাদের সন্তান এসে নানাবাড়ির দিকে সম্পত্তির ভাগ দাবি করতে শুরু করে।

ফলে সেখানে অনেক বেশি এমন মামলা দেখা যায়। শহরের দিকে এ ধরণের মামলার হার এখন কমে গেছে, কিন্তু গ্রামে এখনো এটা অনেক বেশি হারেই চলছে।”

সাধারণ অর্থে যেহেতু জমির পরিমাণ বাড়ছে না, কিন্তু মানুষ বাড়ছে, ফলে ক্রমেই জমির চাহিদা বাড়ছে। এর মানে হচ্ছে, উত্তরাধিকার সূত্রে যারা জমির মালিকানা দাবিদার, তাদের সংখ্যা বাড়ছে।

এর ফলে জমি ক্রমেই মূল্যবান হয়ে উঠছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নাইমা হক বলছেন, বাংলাদেশের দেওয়ানি মামলার প্রধান উৎস ও কারণ জমি সংক্রান্ত নানাবিধ বিবাদ।

দেওয়ানি মামলা মূলত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়ের করে থাকে।

তিনি বলছেন, “জমির ভাগাভাগি ও মালিকানা বেড়ে যাওয়া একটি বড় কারণ এ সংক্রান্ত বিরোধের। সেই সঙ্গে জমির দাম বেড়ে যাওয়া একটি ব্যাপার।

ফলে জমি খুব মূল্যবান হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে। ফলে জমির ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানা রকম বিরোধ সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে মামলায় গড়ায়।”

এক্ষেত্রে যিনি জমির মালিক তার মধ্যেও বণ্টন সংক্রান্ত আইন বিষয়ক সচেতনতা পুরোপুরি থাকে না, অর্থাৎ সন্তান-সন্ততির মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে যাওয়া বা ওয়ারিশনামা করা এমনটা কমই দেখা যায়।

আবার নিজের প্রাপ্যটুকু নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট হয় না—মূলত উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া জমি নিয়ে এসব অভিযোগ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন মানুষ।

জমিজমা নিয়ে বিবাদের আরেকটি বড় কারণ সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আপত্তি। আর এক্ষেত্রে অভিযোগ আসে বেশিরভাগ সময় নিকটতম প্রতিবেশীর কাছ থেকে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশীর বড় অংশটি হন সাধারণত জ্ঞাতিগোষ্ঠী বা রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়রাই।

অর্থাৎ একই পিতার ঔরসজাত ভাইবোন নন, বরং বাবার ভাই-বোন বা চাচাতো বা খালাতো বা মামাতো বা ফুপাতো ভাইবোনের সঙ্গে বা তাদের শরিকদের সঙ্গে জমির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ হয়।

এক্ষেত্রে যতটা জমি পাওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি জমি নিয়ে কেউ সীমানা নির্ধারণ করে নিতে পারে।

শহর-গ্রাম নির্বিশেষে বেআইনিভাবে জবরদখল করে একজনের জমি দখল করে নেয়া একটি বড় সমস্যা।

এ থেকে মামলামোকদ্দমা তো বটেই, আরো নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে।

আর এ ধরণের সমস্যা বেশি হয় নদী ভাঙনের পর নতুন চর যখন জেগে ওঠে তখন, সরকারের খাসজমি এবং পতিত অবস্থায় থাকা ব্যক্তিগত জমি।

এধরণের ক্ষেত্রে মীমাংসায় পৌঁছানো কঠিন এবং স্বাভাবিকভাবেই মামলা হয় এবং তা দীর্ঘ সময় ধরে চলে।

জমির তথ্যাদি রেকর্ড করার সময় ভুল তথ্য বা কারো অনুপস্থিতির ফলে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দেয়। দেখা যায়, জমি একজনের কিন্তু রেকর্ড হয়েছে আরেকজনের নামে।

কোন ক্ষেত্রে মালিকের নাম ও জমির পরিমাণ ভুল উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও আবার জমির দাগ নাম্বারও ভুলভাবে রেকর্ড করা হয়েছে।

ফলে দলিল বা খতিয়ানে ভুল থাকায় জমি কেনা-বেচায় নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়।

দলিলের ভুল ঠিক করতে লাখ লাখ রেকর্ড সংশোধনের মামলা বিচারাধীন রয়েছে আদালতে।

এসব জটিলতা নিরসনে সরকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিন্তু তারপরও সংকট নিরসন সহজ হয় না।

জমির রেজিস্ট্রেশন, মালিকানার হালনাগাদ তথ্য যাচাই, নামজারিসহ বিভিন্ন সুবিধা সহজ করার জন্য সরকার কয়েকটি সেবা অনলাইনে দেয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালে জমি নিয়ে জালিয়াতি, দুর্নীতি বন্ধের লক্ষ্যে চালু করা হয়েছে ভূমি তথ্য ব্যাংক, এর মাধ্যমে ভূমি মালিকের সংরক্ষিত তথ্য যাচাই করে দেখা যাবে।

এছাড়া ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের জন্য বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় একটি অ্যাপ তৈরি করেছে।

সেই সঙ্গে জমির রেজিস্ট্রেশন এবং মিউটেশন বা নামজারি অনলাইনে করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

কিন্তু এসব সত্ত্বে জটিলতা কাটছে না, আইনজ্ঞরা বলছেন সেটি মূলত মানুষের এসব সেবা সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে।

এসএইচ-০১/২৪/২২ (সাইয়েদা আক্তার, বিবিসি)