আকাশছোঁয়া পণ্যের দামে দিশেহারা মানুষ

আকাশছোঁয়া পণ্যের দামে দিশেহারা মানুষ। ‘অপরিবর্তিত আয়’ দিয়ে নিত্যপণ্যের চড়া দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে। যদিও সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, মানুষের আয় বাড়ছে। চলতি বছরের মধ্যে দেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় তিন হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে- এমন আশ্বাসও শোনা যাচ্ছে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছ থেকে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘২০০৯ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০০ ডলার নিচে। গত এক যুগে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরের মধ্যে তিন হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাথাপিছু আয় বাড়াতে সরকার চেষ্টা করছে। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। জাপান-কোরিয়াও কষ্ট করে এগিয়ে গেছে। আমাদেরও সেভাবে এগিয়ে যেতে হবে।’

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মাথাপিছু আয়ের বিষয়টি গড় হিসাব। সবার সম্মিলিত আয় যোগ করে মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিয়ে মাথাপিছু আয় ধরা হয়। তারা বলছেন, হাতেগোনা কিছু মানুষ টাকার ভারে ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। তাদের আয় বাদ দিলে বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে। অথচ বাস্তবতা হলো এখন মধ্যবিত্তরাও নিজে, না হয় বাসার কাজের লোককে টিসিবির লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন গত সপ্তাহে এক গবেষণায় বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। অথচ সরকারি খাতায় খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়ও কম। কিন্তু এটা বাস্তবতার তুলনায় সঠিক চিত্র নয়। নিম্নআয়ের মানুষের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতিও বেশ বেড়েছে।

ড. ফাহমিদা বলেন, ‘খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একটি বাড়লে আরেকটি কমে। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেশি। একেকটি পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ১৫, ২০ ও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। তার পরও কীভাবে বলব, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল? বাজারে সেটা লক্ষ করছি না। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মূল্য যদি আলাদাভাবে দেখি, তা হলে দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়েছে দেখতে পাই। তার পরও শুনছি মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ দেখি না। সংকটের সময় কিছু আমদানিকারক ও বিক্রেতাকে বেশি সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি চলমান রাখা দরকার হয়ে পড়েছে। যদিও সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এর পরিসর বাড়াতে হবে। ন্যায্যমূল্যের প্রক্রিয়াটি দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সংকট পরিস্থিতিতে নগদ সহায়তা চালু রাখা যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

অন্যদিকে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে প্রায় সব কিছুর খরচ। বাড়তি মূল্যের এই যন্ত্রণা, বিশেষ করে সীমিত আয়ের লোকেরা এমন মাত্রায় অনুভব করছে, যা আগে কখনো করেনি। প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্য তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে, স্বাভাবিক কেনাকাটা কমাতে এবং সেগুলোর সস্তা বিকল্প সন্ধানে নামছেন তারা।

সর্বশেষ হিসাব বলছে, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যয় বেড়েছে ১২ শতাংশ। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এ তথ্য তুলে ধরে বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসে চাল, আটা, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, শাকসবজি, সাবান ও দুধের দামের ওপর চাপ বাড়ে। ফলে সংসার পরিচালনায় টিকে থাকতে নানা উপায়ে খরচ কমানোর চেষ্টা করছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা।

সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে খরচ কমিয়েছেন মানিকনগরের বাসিন্দা সুমাইয়া খাতুন। প্রতিবছর তার ছেলের জন্য দর্জি দোকান থেকে দুই সেট ‘স্কুল ড্রেস’ বানাতেন। কিন্তু এ বছর গুলিস্তান থেকে কম দামে ছেলের স্কুলপোশাকের জন্য প্যান্ট-শার্ট কিনেছেন। দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন এক লিটার দুধের পরিবর্তে এখন আধা লিটার দুধ খাওয়াচ্ছেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, দিনমজুরদের মজুরি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে না। তাই তারা আগের মতো খাবার কিনতে পারছেন না। শ্রমিক শ্রেণির মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। যখন আয় কমে যায়, তখন নিম্নআয়ের মানুষের প্রথম ক্ষতি হয় তাদের খাদ্য গ্রহণে। জীবনধারণের এই অতি-দারকারি চাহিদা মেটাতে অনেকে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে কাজ করতে পাঠায়। অনেকে চিকিৎসায় খরচ বন্ধ করতেও বাধ্য হয়, যার ফলে ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এমনিতেই আমাদের দেশে পুষ্টিহীনতা একটি বড় সমস্যা। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে মানুষকে, বিশেষ করে শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টির জোগান দিতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে, কমবে শিক্ষাগ্রহণের ক্ষমতাও।’ তিনি বলেন, ‘শিশুখাদ্যে ভর্তুকি দিলেই চলবে না। যাদের ক্ষয়ক্ষমতা নেই, তাদের মাঝে খাবার পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’

করোনাকালে নতুন দরিদ্র বেড়েছে বলে বিশ্লেষণ ও জরিপের মাধ্যমে দেখিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সানেম বলেছিল, দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য সরকার এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে। যদিও সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কোনো জরিপ বা বিশ্লেষণ তুলে ধরেনি। ২০২০ সালের অক্টোবরে এক জরিপে তারা মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছিল।

এই দফায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি। সরকারের পক্ষ থেকে এই যুক্তি বারবার তুলে ধরা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জাহাজভাড়া বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের কাছে বাজার নিয়ন্ত্রণে তিনটি হাতিয়ার রয়েছে। এগুলো হলো- করছাড়, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো ও বাজার তদারকি।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আগামী রমজান উপলক্ষে টিসিবির কার্যক্রম আমরা প্রায় দ্বিগুণ করছি।’ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পণ্য মজুদ রয়েছে। কোনো অসাধু ব্যাবসায়ী কৃত্রিম উপায়ে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসএইচ-১২/৩১/২২ (অনলাইন ডেস্ক, আমাদের সময়)