‘রোডম্যাপ’ কি দেশের ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে না!

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান আন্দোলনের মধ্যেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।

সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০২৩ সালের নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে এবং ডিসেম্বরের শেষে কিংবা জানুয়ারির শুরুতে ভোট-গ্রহণ হবে।

তবে এই কর্মপরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।

তারা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপরেই কোন আস্থা রাখতে পারছেন না। শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে অনড় অবস্থানে আছেন তারা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, এই নির্বাচন কমিশন কমিশন যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকার নিয়োগ দিয়েছে, তাদের পছন্দ মতো লোকজন বসিয়েছে। তাই যতোই রোডম্যাপ দিক, বর্তমানের সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব না।

“প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএম বাদ দিতে বলেছে। কিন্তু তারা বলল ইভিএমে ভোট নেবে। তাদের কোন কথা বা কাজে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের আভাস নেই। তাই এই রোডম্যাপ নিয়ে আমাদের আগ্রহও নেই,” তিনি বলেন।

তার মতে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কারও পক্ষেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার কারণে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপিসহ অধিকাংশ দল।

আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের আধারে ভোট-চুরির অভিযোগ ওঠে। চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই ব্যালট ভর্তি বাক্সের ছবি বিবিসি বাংলার ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।

এসব কারণে ২০১৪ সালের পর সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে সব স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় ভোটারদের অংশগ্রহণ লক্ষ্যজনকভাবে কমে যায়।

দেশের বাইরের মহলেও নির্বাচনের স্বচ্ছতা এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বিগত নির্বাচনগুলোয় অস্বচ্ছতা, ভোট-চুরি ও জালিয়াতির অভিযোগ তুলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের নতুন এই রোডম্যাপ আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচনেরই ইঙ্গিত মাত্র।

“আগের সব নির্বাচনে সরকারের নির্দেশে ভোট ডাকাতি হয়েছে। ওই নির্বাচন কমিশনও ভালো ভালো কথা বলেছিল কিন্তু কিছুই করতে পারেনি,” রহমান বলেন।

”নির্বাচন কমিশন কখনই নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। সমস্যা সরকারের মধ্যে। এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে আমাদের আপত্তি। কারণ সেটা সুষ্ঠু হবে না,” বলেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

নির্বাচন কমিশন বলছে তাদের কাজ নির্বাচন আয়োজন করা।

কোন দল নির্বাচনে যোগ দেবে কি দেবে না কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে কী হবে না, এগুলো তাদের দেখার বিষয় নয়।

আওয়ামী লীগ নেতা ড. আব্দুর রাজ্জাক নির্বাচনে আস্থার সংকটের বিষয়টি স্বীকার করলেও তিনি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই।

“আস্থার জায়গাটা নিয়ে তো সমস্যা আছেই। নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করবে তাদের আস্থা ফিরিয়ে নির্বাচনে ফেরানোর জন্য,” তিনি বলেন।

”তবে যতো আলোচনাই হোক, সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে আর নির্বাচন হবে না। তবে নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হবে, ” ড. রাজ্জাক বলেন।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে। তাহলে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাইরে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না?

এই প্রশ্নে রাজনীতি বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনকে যতোই ক্ষমতা দেয়া হোক না কেন, তার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

“প্রশাসন নিরপেক্ষ না থাকলে কখনোই সুষ্ঠু ভোট হতে পারে না। যখন আমাদের সবকিছুতেই রাজনীতির ছত্রছায়া থাকে। পুলিশ থেকে শুরু করে রিটার্নিং অফিসার। সেখানে কিভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, আমার বোধগম্য নয়,” তিনি বলেন।

এছাড়া নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ দিয়েছে সেটা অসম্পূর্ণ বলছেন তিনি। এই কর্মপরিকল্পনা রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের আস্থা ফেরাতে পারেনি।

দিলারা চৌধুরী বলেন, কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। বিশেষ করেন নির্বাচনের আগে ভোটারদের আস্থা অর্জনে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে ফেরাতে কমিশনের করণীয় কী হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

তাছাড়া, ইভিএমে কিভাবে আস্থা ফেরাবে, পুলিশ-প্রশাসন আর কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে, তফসিল ঘোষণার পর দলীয় নেতাকর্মী এবং এজেন্টদের হয়রানি বন্ধ করা হবে কিনা, এই বিষয়গুলো কর্মপরিকল্পনায় সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি বলে তিনি জানান।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় গলদ রয়েছে, কারণ তাদের রোড ম্যাপে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নতুন বা মৌলিক কোন বিষয় যুক্ত করা হয়নি ।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক মুনিরা খান বলছেন, এবারের নির্বাচন কমিশন শুধুমাত্র ইভিএম এ ভোট-গ্রহণের ওপরেই জোর দিয়েছে যা নিয়ে আগে থেকেই বিতর্ক রয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অন্য দিকগুলো অনেকটাই উপেক্ষিত বলে তিনি মনে করেন।

“নির্বাচন কমিশন যেসব কর্মপরিকল্পনার কথা বলেছে, সব তো রুটিন কাজ। নতুন কোন চ্যালেঞ্জের কথা তারা বলেনি যে আগে এমনটা হয়নি, এবার হবে, এতে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তাহলে তাদের প্রতি হয়তো আস্থা কিছুটা ফিরত,” তিনি বলেন।

”নির্বাচন কমিশন মনে করে ইভিএম বসালেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যাবে। অথচ এই ইভিএম এর প্রতি মানুষের আস্থা আগে থেকেই নেই। যেখানে চেষ্টা করলে ব্যালটেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, সেখানে এতো টাকা দিয়ে কেন ইভিএম আনতে হবে?” প্রশ্ন রাখেন মুনিরা খান।

তার মতে, নির্বাচনের আরও প্রায় দেড় বছর বাকি। এরমধ্যে নির্বাচন কমিশন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে অনাস্থা কাটার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশে যেখানে পর পর দুটো সাধারণ নির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ, এমন বাস্তবতায় নির্বাচনের কমিশনের এই রোডম্যাপের আদৌ কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয় ১৯৯০ সালের পরে এবং এর অধীনে কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়।

তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।

এরপর থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন সব নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে।

এসএইচ-০১/১৬/২২ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)