শেখ মুজিব এর সাথে নিজের তুলনা দিচ্ছেন ইমরান খান!

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তেহরিক ই ইনসাফ দলের নেতা ইমরান খানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য ব্যাপক আলোচনা ও কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে।

গত শুক্রবার থেকে ইমরান খান তার দলের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক নিয়ে এক লং মার্চ শুরু করেছিলেন – যা পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর ঘুরে রাজধানী ইসলামাবাদে এসে শেষ হবার কথা।

এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার লাহোরের কাছে ওয়াজিরাবাদে তার ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে – যাতে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। এখন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ এখন এই গুলিবর্ষণের ঘটনার দিকেই – কিন্তু দুদিন আগে এক জনসমাবেশে ইমরান খান যে মন্তব্য করেন তাও পাকিস্তানের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

গুজরানওয়ালার ওই সমাবেশে ইমরান খান তার ভাষায় “প্রকৃত মুক্তির” এই আন্দোলনকে তুলনা করেছিলেন ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের সাথে।

এখানে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন যা পর্যবেক্ষকদের মতে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মুখে সাম্প্রতিককালে শোনা যায়নি।

ইমরান খান বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছিল কারণ একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট পেলেও তাদের ক্ষমতায় যাবার অধিকার দেয়া হয়নি।

“একজন চতুর ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ তৎকালীন নির্বাচনে বিজয়ী বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ) বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল – যার ফলে দেশ দু-টুকরো হয়ে যায়” – সেই সময়কার পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন ইমরান খান।

নিজের দল পিটিআইকে আওয়ামী লীগের সাথে তুলনা করে ইমরান খান বলেন, তার পার্টিই “বৃহত্তম এবং একক ফেডারেল দল”, কিন্তু তবু সরকার তাকে নতুন নির্বাচনের সুযোগ দিচ্ছে না।

“সবাই জানে যে মুজিবুর রহমান এবং তার দল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতেছিল। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে একজন চতুর রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ ও সামরিক বাহিনীকে সংঘাতের পথে ঠেলে দেন… আর এখন নওয়াজ শরিফ এবং আসিফ জারদারি একই রকম ভুমিকা পালন করছে, তারা চেষ্টা করছে এস্টাব্লিশমেন্টের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে পিটিআইয়ের ক্ষমতায় ফেরার পথ আটকে দিতে” – বলেন ইমরান খান।

এ কথা শোনা গেল এমন একজন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের মুখে – যার নিজের সম্পর্কেই একসময় বলা হতো যে দেশটির ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদ নিয়েই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

তার সরকারকে সমালোচকরা বলতেন “হাইব্রিড” সরকার। এমনকি পরে সেই “সুসম্পর্ক খারাপ হবার” জল্পনাও ছিল দুনিয়াজোড়া সংবাদমাধ্যমে বড় খবর।

ইমরান খান যে নির্বাচনের কথা বলছেন তা হয়েছিল ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাংশে মোট ৩০০টি আসনে ভোটাভুটি হয়েছিল।

নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়ী হয়। জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে জয়ী হয় ৮১টি আসনে।

ফলে সেই নির্বাচনে শুধু পূর্ববঙ্গে নয়, গোটা পাকিস্তানেই সার্বিকভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ।

কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টো নানা কৌশল করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেননি। ফলে বাঙালিদের তীব্র বিক্ষোভ স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয় – ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পর আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে।

তখন তাকে দেখা হতো এমন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে – যিনি একজন সাবেক ক্রিকেট তারকা হিসেবে জনপ্রিয় তো ছিলেনই, পাশাপাশি যার প্রতি পাকিস্তানের ‘এস্টাব্লিশমেন্টের’ গোপন সমর্থনও ছিল।

পাকিস্তানে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে বোঝাতে এস্টব্লিশমেন্ট কথাটি ব্যবহার করা হয় – যারা পর্দার পেছন থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই “ইমরান খানকে তৈরি করেছে এবং তাকে ক্ষমতায় এনেছে” – বিবিসিকে কিছুকাল আগে বলেছিলেন খানের দল ত্যাগকারী একজন নেতা।

কিন্তু ক্ষমতায় আসার কিছুকাল পরে সামরিক বাহিনীর সাথে ইমরান খানের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।

কিছু পর্যবেক্ষক বলেন, ২০২১ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের একটি গোয়েন্দা এজেন্সির নতুন প্রধানের নিয়োগ অনুমোদন করে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করেছিলেন ইমরান খান – এবং এটি তার সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারানোর একটি কারণ।

খানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলো এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ছাড়েনি।

এ বছরের এপ্রিল মাসে তার বিরুদ্ধে আনা একটি অনাস্থা ভোটের সময় তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের বেশ কিছু এমপি দলত্যাগ করায় তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান।

ইমরান খান এর পর থেকেই বলে আসছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকারকেও তিনি বলে থাকেন – এটি হচ্ছে “ইমপোর্টেড” বা ‘আমদানিকৃত’ সরকার।

পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মানসুর মালিক বলছিলেন, সম্প্রতি সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইমরান খান আরো বেশি “আক্রমণাত্মক বক্তব্য” দিচ্ছিলেন।

“বিশেষ করে আরশাদ শরিফ নামে একজন সাংবাদিক হত্যাকান্ডের পর ইমরান খানের কথাবার্তার প্রেক্ষাপটে ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআইএর প্রধান এক প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করেন – পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগে কখনো ঘটেনি। ”

এ ধরনের বক্তব্যের ধারাবাহিকতাতেই ইমরান খান তার লং মার্চ কর্মসূচি শুরুর পর ১৯৭০-৭১এর প্রসঙ্গ তুলে সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে আরো একদফা আক্রমণ শানালেন – বলছেন মানসুর মালিক।

“পাকিস্তানে ১৯৭০-৭১এর ঘটনাবলী নিয়ে নানা সময় নানাভাবে আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু ওই ঘটনাবলীর সাথে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা – তাও আবার একজন রাজনীতিবিদের মুখ থেকে – কখনো শোনা যায়নি” – বলছিলেন তিনি।

“ইমরান খান নিজেকে তুলনা করছেন শেখ মুজিবের অবস্থানের সাথে, আর শাহবাজ শরিফ ও আসিফ জারদারিকে তুলনা করছেন জুলফিকার আলি ভুট্টোর ভূমিকার সাথে।”

লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক এবং পাকিস্তানের রাজনীতির একজন বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলছিলেন, পাকিস্তানের সমাজে একটি শিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশ আছে যারা উনিশশ’ সত্তর-একাত্তর সালে যা ঘটেছিল তাকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের আলোকেই দেখে থাকেন।

“তবে ইমরান খান এখন একে ভিন্নভাবে তুলে ধরতে চাইছেন তার নিজের সুবিধার জন্যই। পাকিস্তানে এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেভাবে ১৯৭১এর ঘটনাবলী বর্ণনা দেয়া হয়- তাতে একে ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ বলেই তুলে ধরা হয়। কিন্তু ইমরান খান বলছেন যে তখন যা ঘটেছিল এবং এখন যা ঘটছে – তার জন্য সামরিক বাহিনীই দায়ী । তারা ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবকে বঞ্চিত করেছিল এবং এখন তাকে অর্থাৎ ইমরান খানকে বঞ্চিত করছে” – বলছেন আয়েশা সিদ্দিকা।

তিনি বলছেন “ইমরান খান এমন এক সময় এ নিয়ে কথা বলছেন যখন পাকিস্তানের একটি প্রজন্ম সামরিক বাহিনীর এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি এর সুযোগ নিচ্ছেন এবং মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ১৯৭১ সালে কি হয়েছিল।”

সাংবাদিক-বিশ্লেষক মানসুর মালিক বলছেন, ইমরান খানের লক্ষ্য নতুন নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা।

“তিনি ১৯৭১এর প্রসঙ্গ তুলেছেন একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে – সেটা হলো সামরিক এস্টাব্লিশমেন্ট এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা – যাতে নতুন নির্বাচন দেয়া হয়। কারণ মি. খান মনে করেন, নির্বাচন হলে তিনিই জিতবেন।

পাকিস্তানে আগামী নির্বাচন হবার কথা ২০২৩ সালের অক্টোবর নাগাদ। পিপিপি এবং মুসলিম লিগ (নওয়াজ) কেউই তার আগে নির্বাচন হোক তা চায় না।

সে কারণে ইমরান খান বলছেন, দরকার হলে তিনি এক বছর ধরেই তিনি তার এই লংমার্চ চালিয়ে যাবেন।

আয়েশা সিদ্দিকা বলছিলেন, ইমরান খান ১৯৭০ এর নির্বাচন-পরবর্তী বাস্তবতার সাথে বর্তমান পাকিস্তানের যে তুলনা দিচ্ছেন – তা সঠিক নয়।

“তিনি ভুল তুলনা দিচ্ছেন। বর্তমানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে ঠিকই – কিন্তু তার দল এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল নয়।”

“পাঞ্জাবসহ কিছু এলাকায় তেহরিক-ই-ইনসাফের জনপ্রিয়তা বেড়েছে – কিন্তু সব জায়গায় নয়। যেমন, ইমরান খানের জনপ্রিয়তার কারণে পাঞ্জাবে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগের ভোট হয়তো খানিকটা কমে গেছে কিন্তু তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সিন্ধ প্রদেশে পিপিপির ক্ষেত্রেও তাই” – বলেন আয়েশা সিদ্দিকা।

“এ জন্যই ১৯৬০এর দশক বা ১৯৭০ সালের শেখ মুজিবের সাথে ইমরান খানের তুলনা নির্ভুল নয়।”

“তবে একটি ক্ষেত্রে তার এই প্রতিতুলনার কিছুটা যৌক্তিকতা আছে – সেটা হলো, সামরিক এস্টাব্লিশমেন্ট ইমরান খানের জনপ্রিয়তার ভীত এবং তারা ও তাদের সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোও এখন নির্বাচন দিতে চায় না” – বলেন অধ্যাপক আয়েশা সিদ্দিকা।

মানসুর মালিক বলছেন, ১৯৭০-৭১ সালের ঘটনার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ইমরান খান স্পষ্টতই সামরিক এস্টাব্লিশমেন্টের প্রতি একটা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন।

“সম্প্রতিক সময় তিনি প্রায় প্রতিদিনই এরকম সতর্কবাণী উচ্চারণ করে চলেছেন। বলেছেন যে নির্বাচন নিশ্চিত না করা হলে দেশে অরাজকতা দেখা দেবে, রক্তপাত ঘটবে। লংমার্চ শুরুর আগেও তিনি এক টুইট করেছিলেন যার মূল বার্তা ছিল এরকম ‘এস্টাব্লিশমেন্ট কিভাবে দেশে শান্তি আনতে চায় – ব্যালট দিয়ে নাকি রক্তপাত দিয়ে?”

“এমনকি তার ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার পরও তিনি একজন সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে এর পেছনে ভুমিকা রাখার জন্য দায়ী করেছেন” – বলেন মানসুর মালিক।

মানসুর মালিক বলছেন, ইমরান খান স্পষ্টতই ১৯৭০-৭১এর পরিস্থিতির সাথে পাকিস্তানে বর্তমান অবস্থার তুলনা করার সময় শুধু সামরিক বাহিনী নয়, নির্বাচন কমিশনের মত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং মুসলিম লিগ (এন) ও পিপিপির মত রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ জন্য দায়ী করছেন।

তবে তিনি বলেন, এই দলগুলো এখন পর্যন্ত এ নিয়ে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

অধ্যাপক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ইমরান খানের এসব কথাবার্তা রাজনৈতিকভাবে তাকে খুব একটা সাহায্য করবে না বলেই তার মনে হয়।

“কারণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে এবং নওয়াজ শরিফের মত রাজনীতিবিদরাও এর আগে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন – বলেন তিনি।

“কাজেই ইমরান খান যা বলছেন এটা কিছুটা আলোচনা-বিতর্কের জন্ম দিতে পারে – তবে তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।”

এসএইচ-০২/০৫/২২ (পুলক গুপ্ত, বিবিসি)