রফতানির আড়ালে টাকা পাচার! সন্দেহের তালিকায় ৭০০ প্রতিষ্ঠান

তৈরি পোশাক রফতানির আড়ালে অর্থপাচারে জড়িত আরও ১৫টি সিঅ্যান্ডএফ এবং ১৪টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে কাস্টমস। এছাড়া সন্দেহের তালিকায় আছে আরও অন্তত ৭শর মতো প্রতিষ্ঠান। শুধু শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের দুটি অনুসন্ধানে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৬৭৯ কোটি টাকা পাচারের তথ্য মিলেছে।

সাধারণ গার্মেন্টসগুলোর ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে রফতানি পর্যন্ত ২৪টি সরকারি সংস্থার লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কিন্তু তৈরি পোশাক রফতানির আড়ালে টাকা পাচারের দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স দূরের কথা, নাম-ঠিকানা পর্যন্ত ভুয়া। চিহ্নিত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্যের আড়ালে রফতানি কোড এবং বিল অব এক্সপোর্টস জালিয়াতি করে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

গত ৫ মাসে ৬৭৯ কোটি টাকা পাচারের রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ১৫টি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান এবং ১৪টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. বশির আহমেদ বলেন, প্রথমটির মধ্যে লিম্যাক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। আর পরবর্তীতে যে ১০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের সঙ্গে ১৪টি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান জড়িত। অভিযুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকের কোনো ঠিকানা নেই, বলা চলে অস্তিত্বহীন। কারণ চালানের সময়কাল হচ্ছে ২০২০ সাল বা ২০১৮ সাল। তখনকার সময়ে হয়তো তাদের অফিস ছিল; কিন্তু এখন আর নেই।

মূলত পাচারকারী এ চক্রটি অন্য প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি এবং কাস্টমসের টু জিরো কোড ব্যবহার করে পণ্য রফতানি করে থাকে। অথচ এর কিছুই ব্যবহারের অনুমোদন নেই চক্রটির। এর কারণের পাশাপাশি তৈরি পোশাকের আড়ালে এ টাকা পাচার হলেও তার দায় নিতে রাজি নয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।

বরং সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকেই দুষছেন তারা। বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, এসব প্রতিরোধ করতে হলে সঠিক আইনকে আরও শক্তিশালী করে তা কাস্টমস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ তারা ইএক্সপি করছে। তারা নো কমার্সিয়াল ভ্যালুতে কিভাবে ইক্সপি করবে? কেননা, কাঁচামালের বা যে কোনো পণ্যের একটি নির্দিষ্ট মূল্য থাকতে পারে। সেই মূল্য ছাড়া পণ্য কিভাবে রফতানি হচ্ছে? যাদের পণ্য রফতানি হচ্ছে তাদের কি বন্ড লাইসেন্স আছে কি না। কিংবা তাদের রফতানি লাইসেন্স আছে কি না। এবং সেই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার আওতাভুক্ত কি না। যেমন-আমরা তৈরি পোশাক রফতানি করতে আমাদের ২৪টি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো লাইসেন্স আছে কি না।

প্রায় ৭০০ কোটি টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ভিন্ন নামের ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা হলেও সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে নাম এসেছে অন্তত ১০টির। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে নগরীর আগ্রাবাদ এবং খাতুনগঞ্জ। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম আকতার হোসেন বলেন,
এখানে তো আমাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কোনো কিছু নেই। আমরা দলিলাদি জমা দিয়েছি। আমরা তো জানি না ওই দলিলের মধ্যে কি আছে। কাস্টমস যখন নিরীক্ষা করতে পণ্য দেখতে যায়, তখন আমরা পণ্য খুলে দেখাই। কাস্টমস অফিসার যেই চোখে পণ্য দেখছেন। আমরাও সেই চোখেই পণ্য দেখছি। তারা সেখানে কোনো অনিয়ম পেলে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন,
এটি কি শুধু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের পক্ষে করা সম্ভব? কার পাসওয়ার্ডে হয়েছে বা কীভাবে এটি শুল্কায়ন হয়েছে; এ বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।

এ অবস্থায় বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের শনাক্তে নতুন একটি ডাটাবেইজে কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। আর সন্দেহের তালিকায় রয়েছে অন্তত ৭০০ প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার ব্যারিস্টার বদরুজ্জামান মুন্সি বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং ঝুঁকিপূর্ণ আমদানিকারক বা রফতানিকারকদের নির্ধারণ করছি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের পণ্য রিস্ক ম্যানেজমেন্টের ভিত্তিতে নিরীক্ষা করা হবে। তারা যাতে কোনো ধরনের রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে যোগ হতে না পারে সেই সব ক্ষেত্রে যে সব কার্যক্রম নেয়া প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে কাস্টমস হাউজ চট্টগ্রাম ইতোমধ্যে অনেক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ওজন করেই পণ্য রফতানি করা হয়েছে। আর এসব পণ্যের গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকা এবং ইউরোপের ২০টি দেশ।

বছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। কিন্তু না ,কৌশলেও টাকা পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে অসাধু সিঅ্যান্ডএফ এবং আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া গেলে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে – এমনটিই বলছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।

এসএইচ-১২/০৫/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)