রাজশাহীর মমতা নার্সিং ইনস্টিটিউট অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা

সবেমাত্র ক্লাসে ফিরেছে রাজশাহীর মমতা নার্র্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন ক্লিনিক্যাল প্র্যাকিটিসে। হাতে-কলমে দক্ষ হয়ে উঠছেন মানবসেবায়। কিন্তু এরই মধ্যে নতুন করে প্রতিষ্ঠানটিকে অস্থিতিশীল করতে উঠেপড়ে লেগেছে স্থানীয় একটি চক্র।

প্রতিষ্ঠানটির সম্মানীত অবৈতনিক চেয়ারম্যান ঢাকা পুলিশের বিশেষ শাখার সুপার আবদুর রহিম শাহ চৌধুরী। তার দৃঢ়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। চেয়ারম্যানকে ঠেকাতে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া হয়েছে লিখিত মিথ্যা অভিযোগ। নানান কায়দায় চলছে হুমকি ও অপপ্রচার। তবে এসবের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটিকে পাঠদানের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল। ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকেই তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারী কোর্সের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম ব্যাচে ৪৫ জন, দ্বিতীয় ব্যাচে ৩৬ জন এবং তৃতীয় ব্যাচে ৪৯ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।

শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির দাপ্তরিক ঠিকানা দেখানো হয় চেয়ারম্যান আবদুর রহিম শাহ চৌধুরীর পৈত্রিক নিবাস, নগরীর হেতেমখা বি-২৩৪ ভবন। যদিও ভবনটির কিছু অংশ আগে থেকেই ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দ্য়ো আছে। প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয় নগরীর বহরমপুর সিটি বাইপাস এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে।

কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটি চলে যায় নগরীর বালিয়াপুকুর (দেবিসিংপাড়া) এলাকার স্থায়ী ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাস ভবনের একটি অংশের মালিকানা আবদুর রহিম শাহ চৌধুরীর।ক্যাম্পাস এর জন্য ভবনটি ভাড়ার বিনিময়ে নেয়ার কথা থাকলেও মালিক পক্ষের সাথে চুক্তি করেননি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শবনম মোস্তারি মমি এবং মনিরুজ্জামান বাবুল।

অভিযোগ রয়েছে, মনিরুজ্জামান বাবুল ও শবনম মোস্তারি মমি ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি ও বেতন বাবদ আদায় ৫০ লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানে জমা না করে আত্মসাৎ করেন। আত্মসাৎ করেন ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের নামে আদায় করা আরো ৩ লাখ টাকা। বিধি অনুযায়ী, ৫ শতাংশ দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির কথা থাকলেও তা করেননি। উল্টো অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়েছেন। এছাড়্ওা অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং অধ্যক্ষ না থাকায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

বন্ধ ছিলো ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস। প্রতিবাদ করায় উল্টো নানান ভাবে হয়রানির শিকার হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিবােেদর শাস্তিস্বরূপ ছাত্রছাত্রীদের রেজিস্টেশন কার্ড ্ও সাটিফিকেট হাতিয়ে নিয়ে জিম্মি করেন মনিরুজ্জামান বাবুল ও শবনম মোস্তারি মমি। এই দুই কর্মকর্তার নানান অপকর্মের প্রতিকার চেয়ে ২৫ নভেম্বর ২০১৮ নার্সিং কাউন্সিলে অভিযোগ দেন শিক্ষার্থীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদিন পরে ২৭ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে নার্সিং কাউন্সিল। কমিটির সদস্যরা হলেন-রাজশাহী ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ সাদেকা খাতুন ও রাজশাহী নার্সিং কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মনিজ্জা খাতুন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায় কমিটি। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে গোপন প্রতিবেদন দেয় কমিটি।

সূত্র আরো জানায়, অবৈতনিক চেয়ারম্যান হওয়ায় এতদিন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করেননি আবদুর রহিম শাহ। এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা তাকেও অভিযোগ দেন। পরিস্থিতি জানতে চায় নার্সিং কাউন্সিলও। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে উদ্ভুত পরিস্থিতি অবগত করেন চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠানের হতাশাগ্রস্থ ছাত্রছাত্রীদেও মাঝে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযুক্ত এই দুই কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগ করে পাঠদান কার্যক্রমে গতি আনেন।

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মনিরুজ্জামান বাবুল ও শবনম মোস্তারি মমি নগরীর কলাবাগান ডা. রাজিব চত্বর এলাকায় একই নামে প্রতিষ্ঠান চালু করেন। অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সেখানে নিয়ে যাবার চেষ্টাও করেন তারা। শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করতে প্রতিষ্ঠানের নামে অপপ্রচারে নামেন। ওই সময় তারা শিক্ষার্থীদের নাম করে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেন। ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ক্যাম্পাসে তালা ঝুলিয়ে দেন।

এখনো নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মালিক দাবি করেন মনিরুজ্জামান ও শবনম মোস্তারি মমি। এই দুজনের দাবি, তারাই প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিক। তাদের নামেই ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর রাজশাহী সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দেয়। যার নম্বর ০১৯। নিবন্ধন নিতে এই আবেদন জমা পড়ে ওই বছরের ৭ আগস্ট।

তবে এর প্রায় চার মাস আগেই যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধনে জয়েন্ট স্টক কোম্পানী এবং ফার্মস এ আবেদন জমা পড়ে। ১৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির হয়ে শাহ মাহবুবুর রহমান চৌধুরী এই আবেদন করেন। ওই বছরের ১৫ অক্টোবর মমতা নার্সিং ইনস্টিটিউট নামের ছাড়পত্র দেয় জয়েন্ট স্টক কোম্পানী। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী চুড়ান্ত নিবন্ধন পায় প্রতিষ্ঠানটি। যার নিবন্ধন নম্বর সি-১৫০৩৪৭। নিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানটিতে মনিরুজ্জামান ও শবনম মোস্তারি মমির মালিকানা নেই বলে জানা গেছে।

অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে মনিরুজ্জামান ও শবনম মোস্তারি মমি বলেন, আবদুর রহিম শাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক চেয়ারম্যান। এতে তার আর্থিক দায়-দায়িত্ব নেই। কেবল তার ভবন ভাড়া নিয়েছেন মাত্র। কিন্তু তিনিই এখন প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়েছেন। সর্বশেষ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থী ভর্তির ১১ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। প্রতিকার পেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও রাজশাহী নগর পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তারা।

তবে অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান আবদুর রহিম শাহ চৌধুরী বলেন, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি চলবে-এমন শর্তে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে সম্পূর্ণ অবৈতনিক চেয়ারম্যান হিসেবে যুক্ত হন এবং তার মালিকানাধীন ভবনটিতে প্রতিষ্ঠানটি ভাড়া দেন। অথচ শুরু থেকেই মনিরুজ্জামান বাবুল ও শবমন মোস্তারি মমি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, বাড়িভাড়া না দেয়া সহ নানান অপকর্মে জড়িয়েছেন।

বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তারা কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। উল্টো তাকেই চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে নাসিং কাউন্সিলের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদ থেকে এই দুজনকে বাদ দেয়া হয় বলে জানান চেয়ারম্যান।

চেয়ারম্যান আরো জানান, আধুনিক নার্র্সিং ইনস্টিটিউট হিসেবে প্রতিষ্ঠাটি সচল রাখার যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। এরই অংশ হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে প্রয়োজনীয় আসবাবসহ সুপরিসর ক্যাম্পাস। আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ পর্যাপ্ত ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে দেশি ও বিদেশী আধুনিক নার্সিং এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক বই, জার্নাল, সাময়িকি ও পত্রিকা সমৃদ্ধ লাইব্রেরী।

শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তাসহ আবাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন তিনি। প্রতারক চক্রে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে সহযোগিতার আহবান জানান চেয়ারম্যান।

বনেদি ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান আবদুর রহিম শাহ চৌধুরী। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ডা. শাহ বশিরুল হক চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন, ছিলেন জেলা গর্ভনরও। সরকারী চাকুরিতে থাকলেও বাবার পদাঙ্ক অনুসরন করেন আবদুর রহিম শাহ চৌধুরী।

প্রকৌশলশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী হয়েও সেবার মানসিকতা নিয়ে যোগদেন পুলিশে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সততার সাথে দায়িত্বপালন করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

বিএ-০২/০৮-০৩ (নিজস্ব প্রতিবেদক)