শুরু হলো মাগফিরাতের অংশ

পবিত্র রমযান মাসের প্রথম দশ দিন শেষ হয়ে গেল। শুক্রবার থেকে শুরু হলো মাগফিরাতের অংশ। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে জীবনের জানা অজানা গোনাহের ক্ষমা লাভ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আর এ জন্য আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী ইবাদত বন্দেগী করতে হবে। হাদীসে এসেছে এ সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বেশি করে এ দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আবওয়া, ফা’ফু আন্নী’ অর্থাৎ হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে তুমি ভালবাস, সুতরাং আমাদেরকে তুমি ক্ষমা করে দাও।

রোজা এমন একটি ইবাদত যার মধ্যে কোন রিয়া নেই। রোজার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ দিবেন। ইবনে মাজাহতে আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেছেন- ‘আসসাওমুলী ওয়া আনা আযযীবিহী অর্থাৎ রোজা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমিই দিব। কাযী আয়ায বলেছেন, প্রত্যেক ইবাদতের মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানো বা লৌকিকতার সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু রোজার মধ্যে এর সম্ভাবনা নেই। যেমন কেউ রুকু, সেজদা, বৈঠক ইত্যাদি করলো সবাই বলবে নামায পড়ছে। হজ্বে গিয়ে অনুষ্ঠানাদি পালন করলে বলবে হাজী। কিন্তু কেউ গোপনে খেয়ে দেয়ে মানুষের সামনে যতই বলুক আমি রোজা রেখেছি প্রকৃতপক্ষে সে রোজাই রাখেনি। নামাজ, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত আল্লাহ ফরজ করেছেন ঠিকই তবে এদের পরিপূর্ণ বর্ণনা কুরআনে নেই।

রোজার ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সকল বিধান সবিস্তারে যে ভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, অন্যান্য ফরয ইবাদতের তেমন বর্ণনা দেয়া হয়নি। সূরা আল বাকারার ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫ নং আয়াতের বলা হয়েছে যে, রোজা ফরজ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্যও বলা হয়েছে যেন তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো। সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘নির্ধারিত কত দিন। কোন মাসে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে রমযান মাসে। রমযান মাসে কেন? কেন অন্য মাসে নয় তার উত্তরে বলা হয়েছে যে, এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। আবার রোজা পালন করতে না পারলে কি করতে হবে, অসুস্থ, রোগী, মুসাফিরের জন্য করণীয় কি তাও আল্লাহ বলেছেন যা অন্য কোন ইবাদতের ব্যাপারে বলা হয়নি।

যেমন নামাজ, যাকাত আদায় করতে না পারলে এর কাযা ও কাফফারা কিভাবে আদায় করতে হবে তা আল কুরআনে বলা হয়নি বরং রসূল (সাঃ) সবিস্তারে বলে দিয়েছেন। কিন্তু রোজার কাযা ও কাফফারা কখন ও কিভাবে করতে হবে তা আল্লাহ তা’আলা বলে দিয়েছেন। সূরা আল বাকারার ১৮৪ ও ১৮৫ নং আয়াতে তা বলে দেয়া হয়েছে। এদিক থেকেও রোজার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেশি। প্রতি রোজার পরিব্যাপ্তি কতটুকু হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। ‘তোমরা রাত্র পর্যন্ত রোজা পরিপূর্ণ করো।’ সন্ধ্যায় ইফতারের পর খাওয়া-দাওয়া, সহবাস করা যাবে কিনা তাও বলে দিয়েছেন।

সূরা আল বাকারার ১৮৭নং আয়াতে বলা হয়েছে, খাও, পান করো সন্ধ্যার সাদা আভা স্পষ্ট হবার পর থেকে ফজরের কালো রেখা স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত। এ সময়ে স্ত্রী সহবাস বৈধ কিনা এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘সিয়ামের রাত্রিতে স্ত্রী সহবাস তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে? ইতিকাফ রমযান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাল। ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস বৈধ কি বৈধ নয় মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা আল বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকো।’

ইতিকাফ মুর্হুতে সওয়াব বেশি হওয়া স্বাভাবিক। রমযানে তারাবীহ, নফল নামাজ, কুরআন অধ্যয়ন, জিকির ফিকির, তাসবীহখানি ইত্যাদি কাজ হুকুমের দিক থেকে অপরিহার্যতার পর্যায়ভুক্ত না হলেও আরও নানান দিকের বিচারে এগুলোর সওয়াবের পরিমাণ রমযান মাসে অধিক হয়ে থাকে। যেমন পবিত্র কুরআনে প্রিয় বান্দার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তারা আপন প্রভুর উদ্দেশ্যে নামাজে দ-ায়মান এবং সিজদার মধ্য দিয়ে রাত্রি যাপন করে।

আমার নিকট এ বলে প্রার্থনা করো যে, “হে প্রভু আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে দুরে রাখ” কুরআন মজীদের অন্যত্র মহানবীর প্রতি এরশাদ হয়েছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাত্রে ঘুম থেকে জাগা কুপ্রবৃত্তি দমনের একটি কঠোর পন্থা। এবং বক্তব্য হিসেবে সুদৃঢ়। দিনের বেলা তোমার অনেক ব্যস্ততা থাকে। সুতরাং রাতের বেলা তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করো এবং সকল কিছুর সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র তাঁর দিকেই রুজু হয়ে যাও।

উল্লেখ্য যে, মহানবীর দিনের বেলায় কর্মতৎপরতা নবুয়তী কাজের বাইরে ছিল না। তারপরও রাতের গভীরে আল্লাহর প্রতি সম্পুর্ণ রুজু হওয়ার নির্দেশ থেকে একান্ত আল্লাহর ধ্যানের গুরুত্বই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের এ মহৎ কাজগুলো মাহে রমযানের মধ্যে বিশেষ করে রাতের অংশে এবং ইতিকাফে ও মহিমান্বিত শবে কদরে অধিক কল্যাণবাহী হয়ে থাকে। আর এমনি করে রোজার অপরিসীম সওয়াব প্রাপ্তিতে ও লক্ষ্য অর্জনে সোনায় সোহাগার মত কাজ করে থাকে। ইতিকাফ খোদাপ্রেমিক রোজাদারের মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হয়।

এভাবে ফরজ, ওয়াাজিব, সুন্নত ও নফল ইত্যাদি আমলের সওয়াবের অধিকারী ব্যাক্তি সম্পর্কেই সে শুভ সংবাদ প্রযোজ্য হয় যেখানে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি রমযানের রোজা যথারীতি পালন করবে সে যেন সদ্য জন্ম নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় মাসুম-বেগুনাহ বান্দায় পরিণত হয়। আল্লামা ইবনে কাইয়েম বলেন, ইতিকাফের উদ্দেশ্য তাৎপর্য হল, আল্লাহর ইচ্ছার সাথে নিজেকে একাকার করে নেয়া।

ইতিকাফকারী সব ভুলে গিয়ে প্রভু প্রেমে এত বিভোর হয়ে পড়ে যে, তার সকল ধ্যান ধারণা, চিন্তা ভাবনা একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সংসারের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। এ সম্পর্ক ভালবাসা তার কবরের সঙ্গী-সাথীহীন অবস্থার সহায়ক হবে। ইতিকাফকারীর শয়ন -স্বপ্ন সব কিছু ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে। তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হন। হাদিস শরীফে আছে, যে আমার প্রতি এক বিঘত অগ্রসর হয় আমি তার পানে এক হাত অগ্রসর হই। যে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।

সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, আল্লাহ তা’আলা শুধু রোজা ফরযই করেননি বরং এর বিস্তারিত নিয়ম-কানুন, বিধানাবলী বর্ণনা করে দিয়েছেন। হয়তো এ জন্যই আল্লাহ বলেছেন, রোজা আমার জন্যই আর এর প্রতিদান আমিই দিব। রোজার এ মহান গুরুত্বকে সামনে রেখে পরিপূর্ণভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করার জন্য আমাদের চেষ্টা চালানো উচিত।

এসএইচ-০১/১৭/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)