নাজাতের দশক শুরু

যে সব কারণে

সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে নাজাতের দশক। এ দশকে আল্লাহ বান্দাহদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। এ মাসে আল্লাহ অপেক্ষা করতে থাকেন বান্দাহ কখন তার কাছে ক্ষমা চাইবে। ক্ষমা চাইলে আল্লাহ খুশী হন এবং ক্ষমা করে দেন। আর পবিত্র রমযানের এ দশকে বান্দার গুনাহ ক্ষমা করার জন্য বিশেষ রজনী রেখেছেন।

মুয়াত্তা-ই-ইমাম মালেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জানতে পারলেন যে, পূর্বেকার উম্মতের বয়স অনেক দীর্ঘ হতো এবং সে তুলনায় নিজের উম্মতের বয়স অনেক কম। সুতরাং আমার উম্মতের আমলের পরিমাণ এ হায়াতের ব্যবধানে পূর্বেকার উম্মতের আমলের পরিমাণের সমান হতে পারে না। বিষয়টি অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুঃখিত হলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা লাইলাতুল কদর প্রদান করেন। যাতে এ সমস্যা ও দুঃখ দূরীভূত হয়। তাই এমন এক রাত দান করলেন যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদা সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর সামনে বনি ইসরাঈলের এমন এক আবিদ ব্যক্তির বর্ণনা করলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে বিরামহীনভাবে এক হাজার মাস জিহাদ করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর এ বর্ণনা শুনে সাহাবায়ে কেরাম সে লোকটির প্রতি বিমুগ্ধ হয়ে পড়লেন। তখন আল্লাহ পাক এ দীর্ঘ বয়সের বিকল্প স্বরূপ লাইলাতুল ক্বদর প্রদান করেন।

আল কুরআনুল করীম লাইলাতুল ক্বদরে নাযিল হয়েছে। এ রাতে হযরত জিবরাইল (আঃ) ফেরেশতাদের এক বিরাট জামায়াত নিয়ে দুনিয়ার বুকে অবতীর্ণ হন এবং জগতবাসীর মধ্যে লাইলাতুল ক্বদরের কল্যাণ ও প্রাচুর্য বিতরণ করেন। এ বিতরণের কাজ ফজর হওয়া পর্যন্ত অনবরত চলতে থাকে। লাইলাতুল ক্বদর আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিরাট নেয়ামত- যার কোন তুলনা হয় না। এ রাতে ইবাদতের একাগ্রতা হাসিল হয়। অন্তর গাফিল হয় না। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য পাপী বান্দাকে মাফ করে দেন। এ রাতে তওবা কবুল হয়, আসমান-যমীনের রহমতের দরজা খুলে দেয়া হয়। ইবাদতে মাশগুল মুমিনকে ফেরেশতারা সালাম করে। এ রাতে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, তসবীহ-তাহলীল পাঠ করে কাটিয়ে অনেক সওয়াব অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।

লাইলাতুন অর্থ রাত বা রজনী আর ক্বদর অর্থ সম্মান। এর আরেক অর্থ পরিমাপ, নিরূপণ, ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ। তবে রমযানে লাইলাতুল ক্বদর অর্থ সম্মানিত ও মহিমানি¦ত রাত। আমাদের দেশে জনগণের কাছে লাইলাতুল ক্বদরের চেয়ে ‘শবে ক্বদর’ বেশি পরিচিত। শব শব্দটি ফারসী যার অর্থ রাত। তাই শবে ক্বদরের অর্থ সম্মানিত রাত। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেন : লাইলাতুল ক্বদর অর্থ এমন রাত বুঝায়, যাতে যাবতীয় ব্যাপারে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, উহার চূড়ান্ত রূপ দান করা হয় এবং একটি বৎসর কালের জন্য আল্লাহ তা’আলা এ রাতে সব বিধান ও মর্যাদার ফয়সালা করে দেন। সূরা দুখানের ৪নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, এ মহান রাতে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়া হয়। সহল ইবনে আব্দুল্লাহর মতে আল্লাহ তা’আলা তার মুমিন বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণের পরিমাণ এ রাতে নির্ধারণ করেন বলে এ নামকরণ হয়েছে।

‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর কাছ থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে’ (বুখারি ও মুসলিম)। এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)।

‘কিয়ামুল লাইল’ অর্থ হলো রাত্রি জাগরণ। মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বেচ্ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের একটি গুণ। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- ‘তারা রাত্রি যাপন করে রবের উদ্দেশে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে’ (সূরা ফুরকান : ৬৪)।

‘তাদের পার্শ দেশ বিছানা থেকে পৃথক থাকে (অর্থাৎ তারা শয্যা গ্রহণ করে না ; বরং এবাদতে মশগুল থাকে)। তারা গজবের ভয়ে এবং রহমতের আশায় তাদের রবকে ডাকতে থাকে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে দান করে থাকে। কেউ জানে না। তাদের আমালের পুরস্কারস্বরূপ (আখিরাতে) তাদের জন্য কী জিনিস গোপনে রাখা হয়েছে’ (সূরা সিজদা : ১৬-১৭)।

লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, আমি এ কুরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস থেতেও উত্তম ও কল্যাণময়’ (সূরা আল কদর : ১-৩)। এই রাত কোন মাসে ? এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রমজান এমন মাস যাতে কুরআন নাজিল হয়েছে’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। এই রাত রমজানের কোন তারিখে? রাসূলুল্লহ সা: একটি রহস্যময় কারণে তারিখটি সুনির্দিষ্ট করেননি। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিজি কর্তৃক বর্র্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে- হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘কদরের রাতকে রমজানের শেষ দশ রাতের কোন বেজোড় রাতে খোঁজ করো।’

হজরত আবু বকর রা: ও হজরত আবব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও এই একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো ইসলামী মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যামে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে) শবে কদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা: এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি; বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন।

মহিমান্বিত এ রাতকে মহান আল্লাহ রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লুকিয়ে রেখেছেন। বান্দাহ বিনিদ্র্র রজনী কাটাবে, সবর করবে এর মধ্যে খুঁজে পাবে সম্মানিত রাত, পাবে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত; ফেরেশতার অদৃশ্য মোলাকাতে সিক্ত হবে তার হৃদয়, আপন রবের ভালোবাসায় হবে সে উদ্বেলিত। এ যেন দীর্ঘ বিরহের পর আপনজনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। এ দীর্ঘ প্রতিক্ষার কষ্ট-বিরহের মাধ্যমে রব তার বান্দাহকে আরো আপন করে নেন। কাজেই শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদতে মশগুল হতে হবে। প্রতিটি রাতকেই লাইলাতুল কদর মনে করতে হবে।

তা হলে লাইলাতুল কদর আল্লাহর মেহেরবানিতে হাতছাড়া হবে না ইনশাআল্লাহ। রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোই (অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ ও ২৮ শে রোজার দিবাগত রাত ) হলো শেষ দশকের বেজোড় রাত।
হযরত আয়েশা (রাঃ) এ রাতে কি দোয়া পাঠ করবেন জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তর দিয়েছিলেন এভাবে, “কুনী আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন কারীম, তুহিব্বুল আফাওয়া ফা’ফু আন্নী”- অর্থাৎ তুমি বলবে বা পড়বে, হে আল্লাহ, তুমি বড় ক্ষমাশীল, ক্ষমা করা পছন্দ কর, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও। তাছাড়া কুরআন তিলাওয়াত, তাফসীর পড়া ও অন্যান্য ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন, দান-সদকা করাসহ ভাল কাজ করা।

এসএইচ-০১/২৭/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)