ঘরে তালা দিয়ে লাপাত্তা অধ্যক্ষ সিরাজের পরিবার

আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার পরিবার ঘরে তালা দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।

ফেনী শহরের পাঠানবাড়ী এলাকার মকছুদুর রহমান সড়কের ‘ফেরদৌস মঞ্জিল’ নামে দোতলা বাড়িটি অধ্যক্ষ সিরাজের। রোববার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায় বাড়িটি তালাবদ্ধ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ৭ থেকে ৮ বছর আগে ২০ লাখ টাকায় সাড়ে চার শতক জমি ক্রয় করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। প্রথমে টিনশেড বাসা ছিল। তিন বছর আগে দোতলা পাকা দালান করেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে। ৬ তলা ফাউন্ডেশনের ওপর দোতলা বাড়ি। ওই ভবনের দোতলার রাস্তা লাগোয়া বড় ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। কয়েকদিন আগে ঘরে তালা দিয়ে গা ঢাকা দেন পরিবারের সদস্যরা। তারা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে পারেন বলে ধারণা প্রতিবেশীদের।

অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ফ্ল্যাটের সামনে মুখোমুখি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন ফেনী সদরের ফাজিলপুরের মো. ইব্রাহিম। স্ত্রী আর মেয়ে নিয়ে ওই ভবনের দোতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। ইব্রাহিম জানান, ৪ থেকে ৫ দিন আগে ওই বাড়ির লোকজন তালা দিয়ে চলে গেছেন। তবে তারা কোথায় গেছেন-তা বলতে পারেননি ষাটোর্ধ্ব এই প্রতিবেশী।

তিনি বলেন, আমরা আসলে এতো কিছু জানতাম না। বাইরে থেকে তাকে সাধারণ বলেই মনে হত। এখন টিভির খবরে আর পত্রিকায় দেখে ওনার সম্পর্কে জানতে পারছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশপাশের কয়েকজন বাড়ির মালিক ও বাসিন্দা বলেন, মাঝে মাঝে তাকে দেখতাম। সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরতেন। বিভিন্ন সময় তার ব্যাপারে অনেক অভিযোগ শুনেছি। তার পরিবারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

তারা বলেন, এখন তার এসব অপকর্মের কথা জেনে আমরা প্রতিবেশী হিসেবে লজ্জিত ও বিব্রত। তাদের মতে, ফেনী শহরের পাঠানবাড়ী রোড ও মকছুদুর রহমান সড়কে জামায়াত কেন্দ্রিক একাধিক প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন এই সিরাজ। নানাভাবে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি আর্থিকভাবে লাভবানও হন। এসব খাত থেকে পাওয়া অর্থে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে দোতলা বাড়ি তৈরি করেন তিনি।

সোনাগাজীর ৮নং আমিরাবাদ ইউনিয়নের চর কৃষ্ণজয় গ্রামে অধ্যক্ষ সিরাজের বাড়িতে গিয়েও দেখা যায় তার ঘরে তালা। বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে। সোনাগাজী মডেল থানার এসআই কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে চার পুলিশ সদস্য সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন।

অধ্যক্ষ সিরাজের ভাবি (বড় ভাইয়ের স্ত্রী) হাছিনা আক্তার বলেন, সিরাজ উদ দৌলার বাড়িতে একটি ঘর থাকলেও এখানে কেউ থাকেন না। তিনি বাড়িতে খুব কম আসেন। পরিবার নিয়ে থাকেন ফেনীর পাঠানবাড়ীতে।

তিনি বলেন, মেয়েটার (নুসরাত) জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমার দেবর যদি এ ঘটনায় দোষী হন তাহলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

সিরাজ-উদ-দৌলার গ্রামের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. গোলাম কিবরিয়া শামীম বলেন, আমাদের গ্রামটি খুব শান্তিপূর্ণ। একটি ঘটনায় পুরো গ্রাম কলঙ্কিত হয়ে গেছে। আমরা নুসরাত হত্যার কঠিন শাস্তি দাবি করছি।

উল্লেখ্য, নুসরাত জাহান রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিল। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা এর আগে তাকে যৌন নিপীড়ন করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে আটক করে পুলিশ। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যায় নুসরাত। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। তাকে মামলা তুলে নেওয়ার কথা বলে ভয় দেখানো হয়।

পরে সেখানে বোরকা পরিহিত ৪/৫ ব্যক্তি নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে তার স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।

সোমবার দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে ঢামেকের ডাক্তাররা জানান, নাজুক শারীরিক অবস্থার কারণে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া সম্ভব নয়। বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।

বিএ-১১/১৪-০৪ (আঞ্চলিক ডেস্ক)