গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ কৃষকদের!

ইয়েমেনে যুদ্ধের ফলে কৃষিপণ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় দেশটির কৃষকরা গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করছেন। এদিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়েমেনের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও কঠিন আকার ধারণ করছে। এর ফলে ইয়েমেন মানবিক দুর্যোগের শিকার।

দি ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) করা দুর্যোগপূর্ণ দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন।

ইয়েমেনের ব্যাপারে আইআরসির রিপোর্টে বলা হয়,প্রেসিডেন্ট আব্দে রাব্বি মানসুর হাদির পক্ষে সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলায় দেশটি ধ্বংসের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

গত বছরের শেষদিকে জাতিসংঘ সতর্ক করে জানায়, দেশটি মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে যাচ্ছে। বর্তমানে ইয়েমেনের দুই কোটি ৪০ লাখ লোকের জন্য মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। গত বছর সেখানে কলেরা মহামারী দেখা দিলে ১০ লক্ষাধিক লোক এতে আক্রান্ত হয়।

টানা যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ২০১৫ সাল থেকে কৃষিকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন আবদুল্লাহ আল-ওসাবী। চাকরির জন্য সৌদি আরবে পাড়ি জমান তিনি।

ইয়েমেনের হুজ্জা জেলার ৩৩ বছর বয়সী খালিদ আবদুল্লাহ তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিতে কৃষিকাজ করতেন। টমেটো, পেঁয়াজ, আলু এবং ভুট্টা, পাশাপাশি অন্যান্য ধরনের সবজিও শস্য চাষ করতেন তিনি। তিনি কখনও ভাবেননি যে, তিনি বেকার হয়ে যাবেন এবং অন্যদের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবেন।

কিন্তু সবকিছুই এখন পাল্টে গেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে ২০১৫ সাল থেকে চলমান গৃহযুদ্ধ কৃষকদের জীবনযাত্রার মান পুরো পাল্টে দিয়েছে। উল্লেখ্য, হুজ্জা জেলাটি রাজধানী সানা থেকে ১২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি গ্রামীণ এলাকা। বিশেষত জেলাটি হুথিনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবস্থিত।

হুথি বিদ্রোহীরা ২০১৫ সাল থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থনপুষ্ট সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার চরম সংকটে পড়ে।

ইংল্যান্ডভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক অনলাইন সংবাদমাধ্যম মিডলইস্ট আইয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় আবদুল্লাহ বলেন, “আমি কৃষিজমি দ্বারা আমার পরিবারকে সাহায্য করতাম। জ্বালানির দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় আমি আর পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি কিনতে পারি না। এভাবে আমার জমিগুলো অনুর্বর হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, পানির জার ব্যবহার করে আমি জমিনে পানি দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও উপকারে আসেনি। জ্বালানি মূল্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আমি আমার জীবিকার একমাত্র উৎসটি হারিয়ে ফেলেছি।

২০১৫ সালে ২০ লিটার ডিজেল জ্বালানির দাম যেখানে ছিল ২ হাজার ৫০০ রিয়াল (১০ মার্কিন ডলার) তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার রিয়ালে (৪৮ মার্কিন ডলার) বেড়েছে। এই দাম কৃষকদের জন্য আস্তে আস্তে আরও বাড়ছে।

আবদুল্লাহ তার খেতের ফসল দেশের বিভিন্ন অংশে পাঠাতেন। এলাকাটি এখন সেসব অঞ্চলে খাদ্যের অভাব প্রকট।

আব্দুল্লাহ বলেন,বিভিন্ন জেলায় তরিতরকারি পাঠাতে আমার কারও সাহায্যের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না।

সামগ্রিকভাবে,ইয়েমেনের যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। এতে ২ কোটি অধিবাসীর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পরিণত হয়েছে। ফসলের অভাবে বা হুথি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য না থাকায় আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা, পরিস্থিতি প্রতিকার প্রয়াস করছে।

হুজ্জা জেলার আরেকজন হলেন জামাল। তিনি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মিডলইস্ট আই এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৬ সালের আগস্টে বেতন পাই। এরপর থেকে আমাদের জীবন চলছে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানবিক সহযোগিতায়।

হুজ্জা জেলার অনেক শিশু খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে। ইউনিসেফের হিসেব মতে, ১.৮ মিলিয়ন ইয়েমেনি শিশু বর্তমানে অপুষ্টিতে ভুগছে। যাদের মধ্যে চার লাখ গুরুতর অপুষ্টির সম্মুখীন এবং তাদের জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয়তার জরুরি প্রয়োজন। গামাল আরও বলেছিলেন, বর্তমান সংকট হজযার বেশির ভাগ অধিবাসী এবং অন্যান্য প্রদেশগুলো বেকার হয়ে গেছে, যদিও তারা তরুণ দলের অন্তর্গত এবং তাদের প্রস্তাবের উচ্চতা।”

এক হিসাব মতে, বিশ্বের ৪৫ দেশে ৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষের জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন, যা ২০১৫ সালের চেয়ে এ বছর বেড়েছে ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যের সবচেয়ে বেশি অভাব যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে। নারী, শিশুসহ ইয়েমেনের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য নেই। এর মধ্যে ৩০ লাখের বেশি শিশু খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে। ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়াসহ যুদ্ধকবলিত মধ্যপ্রাচ্যে খাদ্যসংকট একটি বড় সমস্যা।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, আগামী ১৫ বছরে বিশ্বে খাদ্য চাহিদা বাড়বে ২০ শতাংশ।

গত অক্টোবর হুথি কর্তৃপক্ষ রাজধানী সানায় প্রতিষ্ঠা করে মানবিক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় কর্তৃপক্ষ। যা ১২টি মন্ত্রণালয়েল সমন্বয়ে গঠিত এবং প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হত। এই কর্তৃপক্ষটি হুথিনিয়ন্ত্রিত এলাকায় আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কাজের তত্ত্বাবধান করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এবং সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে তথ্য সরবরাহ করে।

হুজ্জা জেলায় উক্ত কর্তৃপক্ষ সুপারভাইজার আবদুর রহমান আল-মুআইয়্যাদ। তিনি মিডলইস্ট আইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এখানে যারা বসবাস করছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছেন যাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। মানবিক সাহায্যই তাদের একমাত্র আয়ের অবলম্বন। এনজিওগুলো থেকে যা দেয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয়। তাই অনেকে খাদ্যের অভাবে গাছের পাতা খেয়েও জীবনযাপন করছে।

তিনি বলেন,আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্তাগুলোর ইয়েমেনিদের সাহায্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা প্রত্যাখ্যান করা যায় না। কিন্তু আমরা আশা করব, তারা আমাদের আরও সহায়তা দেবে যাতে আমরা সব প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারি।

তিনি আরও বলেন, আমি মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে দরিদ্রদের এড়িয়ে চলি; কারণ মানুষ যখন আমার কাছে সাহায্য চায়, তখন আমি দুঃখ পাই। তাদেরকে ফিরিয়েও দিতে পারি না।

এসএইচ-২৪/০৫/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : নুন পোস্ট)