যেসব শাসকের ভয়ে গোটা বিশ্ব কাঁপত

এই মুহূর্তে যদি কয়েকজন স্বৈরশাসকের নাম বলতে বলা হয় তাহলে হয়তো প্রথমেই মাথায় আসবে হিটলারের নাম। ১৯৩০ সালে জার্মানির ক্ষমতায় বসে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক হত্যাযজ্ঞ চালান হিটলার। ভয়ংকর রকমের বর্ণবাদী ছিলেন তিনি। যার রেশ ধরেই ১ কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়। হিটলারের জেদ আর রাগের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, যে যুদ্ধে সারা পৃথিবীর ৫-৭ কোটি মানুষ মারা যায়। হিটলার ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন। ছোট-বড় কমবেশি সবাই হিটলারের নাম জানলেও এ তালিকায় আছে বেশ কিছু শাসকের নাম।

চেঙ্গিস খান (শাসনকাল : ১২০৬-১২২৭)
ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন ভয়ংকর যোদ্ধা অন্যতম বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ ও সেনাপতি চেঙ্গিস খান। নিজ নেতৃত্বগুণে বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন তিনি। তবে বিশ্বের কিছু অঞ্চলে চেঙ্গিস খান অতি নির্মম ও রক্তপিপাসু বিজেতা হিসেবে চিহ্নিত। তার নির্দেশেই সেনারা রাজ্য দখল করতে কোটি কোটি নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে এরপর পরাজিত সম্রাটের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখতেন না। এমনকি শিশুদেরও।

তৈমুর (শাসনকাল : ১৩৭০-১৪০৫)
তৈমুর ছিলেন ১৪শ শতকের একজন তুর্কি-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ। তিনি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজ দখলে এনে তিমুরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজ্য জয়ের যুদ্ধে সব জায়গাতেই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতেন তৈমুর। এই শাসকের নির্দেশেই জীবন্ত মানুষকে ইট-বালুর সঙ্গে মিশিয়ে টাওয়ার নির্মাণ করেছিলেন তিনি। ইরানের ইসপাহানে বিদ্রোহের শাস্তি দিতে জনসাধারণকে গণহত্যার আদেশ দিয়েছিলেন এবং ৭০ হাজার মাথার খুলির সমন্বয়ে মিনার তৈরি করেছিলেন।

ব্লাদ ৩ (শাসনকাল : ১৪৪৮; ১৪৫৬-১৪৬২; ১৪৭৬)
কুখ্যাত প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ওয়ালেশিয়া রাজ্যের যুবরাজ তৃতীয় ব্লাদ। শূলে চড়ানোর মাধ্যমে শত্রুদের নৃশংস মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সমালোচিত তিনি । ১৪৬২ সালে এক যুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার তুর্কিকে আটক করে ব্লাদের সৈন্যরা। আটক ব্যক্তিদের প্রত্যেককে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ দাবি করেছেন, ব্লাদ মানুষের রক্ত পান করতেন। তাই এই যুবরাজ ড্রাকুলা পরিচয়েও পরিচিত। ইতিহাসবিদের মতে, ব্রাম স্টোকারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’ চরিত্র সৃষ্টি হয়েছিল ব্লাদ ৩-এর ইতিহাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে। পনেরোশ শতকের এক জার্মান কবিতায় উল্লেখ করা হয়েছে ভ্লাদ তার বন্দিদের সঙ্গে বসে খাবার খেতেন। তাদের টেবিলেই মেরে তাদের রক্তে রুটি ভিজিয়ে নিতেন। হাত ধুতেন শত্রুর রক্ত দিয়ে।

জার ইভান চতুর্থ (শাসনকাল : মস্কোর গ্রান্ড প্রিন্স হিসেবে ১৫৩৩-১৫৪৭, পুরো রাশিয়ার জার হিসেবে ১৫৪৭-১৫৮৪)
৩৭ বছর রাশিয়ার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন জার চতুর্থ ইভান। নৃশংসতার জন্য ‘ইভান দ্য টেরিবল’ নামেও তিনি পরিচিত। একদিকে যেমন তিনি দেশের সীমানা সম্প্রসারিত করতে পেরেছিলেন, অন্যদিকে তার খামখেয়ালিপনা, নৃশংসতা রাজ্যবাসীকে সারাক্ষণ উদ্বেগে রাখত। তার নিষ্ঠুরতা থেকে অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূও রেহাই পায়নি এমনকি তিনি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজ পুত্রকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেননি। মানুষের ওপর অত্যাচার করতে পছন্দ করতেন। এসব কারণে মানুষজন যেন পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য শহরের চারপাশে দেয়াল তৈরির আদেশ দিয়েছিলেন।

লিওপোল্ড দ্বিতীয় (শাসনকাল : ১৮৬৫-১৯০৯)
বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গোতে নির্দয় শোষণের কারণে অত্যাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত। ১৮৬৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার শাসনামলে ১৮৮৫ সালে কঙ্গো কিনে নিয়ে সে দেশের জনগণকে দাসে পরিণত করেন। এখান থেকে তিনি হাতির দাঁত, রাবার এবং অন্যান্য খনিজদ্রব্য সংগ্রহ করতেন। কোনো শ্রমিক নির্দিষ্ট পরিমাণ হাতির বা রাবার সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। তবে তার বাহিনীর অফিসারদের দয়া হলে কুমিরের চামড়ার চাবুক খেয়েই অনেকে বেঁচে যেত। রাবার সংগ্রহের পদ্ধতি ছিল লোমহর্ষক ও নিষ্ঠুরতায় ভরা। রাবার সংগ্রহকারীরা রাবার গাছের জঙ্গলে, গাছের পাতায় ও লতায় লম্বা দা দিয়ে আঘাত করত, সেই আঘাতে অনেক সময় তরল রাবার ছিটকে এসে তাদের গায়ে আটকে যেত। এসব রাবার পরে দা কিংবা ছুরি দিয়ে শরীর থেকে ওঠানো হতো। ওঠানোর সময় বেশির ভাগ সময়ই কঙ্গোবাসীর গায়ের চামড়া পশমসহ উঠে আসত। তার নির্দয় অত্যাচারে কঙ্গোর ৩০ লাখ লোকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কারো কারো মতে, মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এক কোটি, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ। দুর্ভিক্ষ, স্ত্রী-পুরুষ আলাদা থাকা আর হাজার হাজার বিদ্রোহী নিধনের কারণে ১৮৮০ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কঙ্গোর জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়।

তালাত পাশা
১৯০৮ সালে এক বিপ্লবের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট সুলতান আবুল হামিদকে উৎখাত করে ‘ইয়াং টার্ক’ বা ‘তরুণ তুর্কি’ দল ক্ষমতায় আসে। সেখানে ছিলেন তালাত পাশা, জামাল পাশা ও আনোয়ার পাশা। তরুণ তুর্কির নেতৃত্ব দিতেন তালাত পাশা। আর্মেনিয়ান জাতিটিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অভিযানে নেমে ১৯১৫-১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলা আর্মেনিয়ানদের ওপর নৃশংস গণহত্যায় জাতিটির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ১৫ লাখ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মেয়েশিশুদের অনেককেই তারা ধর্ষণ করে বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রয় করে দেয়। এই গণহত্যার মূল নকশাকার ও কারিগর ছিল তালাত পাশা।

এই স্বৈরাচারী শাসকের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। যুগে যুগে বহু স্বৈরাচারী শাসক এসেছে যারা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।

এসএইচ-১১/২৩/২২ (অনলাইন ডেস্ক)