ম্যাচ ফিক্সার থেকে বিশ্বকাপ জয়ের মহানায়ক

খলনায়ক থেকে মহানায়ক। ভূত থেকে দেবতা! বিশেষণগুলো শুধু পাওলো রসির। ম্যাচ ফিক্সার থেকে যিনি বনে গিয়েছিলেন ইতালির ১৯৮২’র বিশ্বকাপ জয়ের কারিগর। বিশ্বের একমাত্র ফুটবলারও তিনি, যার দখলে একই বছরে বিশ্বকাপ, গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট ও ব্যালন ডি’অর জয়ের কীর্তি রয়েছে।

অমরত্ব ধুলোয় কুড়িয়ে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নিতে অবশ্যই করতে হয় অতি মানবীয় কিছু। ১৯৮২’র বিশ্বকাপে তাই করেছিলেন পাওলো রসি। অথচ সেবার তাকে কিছুতেই স্কোয়াডে দেখতে চায়নি সমালোচকরা। আর চাইবেই বা কী করে? ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে দুই বছর ফুটবলের বাইরে থাকা কাউকে তো আর হুট করেই বিশ্বকাপে খেলিয়ে দেয়া যায় না! তবুও সেই ঝুঁকিটাই নিয়েছিলেন কোচ এনজো বিয়ারজট।

স্পেন বিশ্বকাপে মোটেও ফেভারিট ছিল না ইতালি। বরং সক্রেটিস, জিকো, ফ্যালকাওদের নিয়ে গড়া ব্রাজিল স্কোয়াড ছিল অপ্রতিরোধ্য। এই দলটাই হেরে গিয়েছিল পাওলো রসির কাছে। সেই রূপকথা অমরত্বের আসনে বসিয়েছে কিংবদন্তিকে। তবে এর পেছনের গল্পটাও জানা দরকার।

১৯৭৭ সালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ইতালির হয়ে অভিষেক হয় পাওলো রসির। পরের বছর বিশ্বকাপে তিন গোল করে তিনি জিতেছিলেন সিলভার বল। ক্লাব ফুটবলে তখন তার ঠিকানা ভিসেঞ্জা। কিন্তু পরের মৌসুমে তার ক্লাব সেরি আ থেকে রেলিগেটেড হলে টপ টিয়ারে খেলার আশায় তিনি পাড়ি জমান পেরুজিয়ায়। এখানে খেলতে গিয়েই তার ক্যারিয়ারে নেমে আসে অন্ধকার।

ইতালির ফুটবল ১৯৮০ সালে টালমাটাল করে দেয় টটেনেরো বা ব্ল্যাক লটারি অধ্যায়। সেবার সেরি আ’র অন্তত সাতটি ম্যাচ পাতানো হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল পেরুজিয়া-অ্যাভেলিনো ম্যাচ। এই ঘটনায় অভিযুক্ত হন পাওলো রসি। তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়া হয় দুই মিলিয়ন লিরা ঘুস গ্রহণের। অভিযোগ অস্বীকার করলেও ইতালি ফুটবল তাকে নিষেধাজ্ঞা দেয় তিন বছরের।

কেটে যায় দুই বছর। দরজায় কড়া নাড়ছে তখন স্পেন বিশ্বকাপ। এনজো বিয়ারজট গো ধরে বসেন দলে লাগবেই রসিকে। এক বছর কমানো হয় নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বকাপ শুরুর আগে মাত্র তিন ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি য়্যুভেন্তাসে। কোচের এই সিদ্ধান্তে বয়ে যায় সমালোচনার ঝড়। কিন্তু এনজো ছিলেন সিদ্ধান্তে অটল।

অবশ্য কোচের আস্থার প্রতিদান গ্রুপ পর্বে দিতে পারেনি রসি। প্রথম রাউন্ডে তার পা থেকে আসেনি কোনো গোল। ইতালির অবস্থাও যাচ্ছে তাই। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে কোনো জয় ছাড়াই দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে ইতালি। গণমাধ্যমে শুরু হয় সমালোচনা। একটা ভূত উদ্দেশ্যহীনভাবে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে। পাওলো রসিকে নিয়ে এমন কথা লেখা হয় ইতালির পত্রিকায়।

সেবার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড ছিল ভিন্ন নিয়মে। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে আসরে প্রথম জয় তুলে নেয় ইতালি। তবে গোল পাননি রসি। পরের ম্যাচে ব্রাজিল আলবিসেলেস্তেদের আরও বড় ব্যবধানে হারালে কঠিন হয়ে উঠে ইতালির সেমিফাইনাল সম্ভাবনা। সে ম্যাচেই জ্বলে উঠেছিলেন মহানায়ক। পাঁচ মিনিটে গোল করেন পাওলো রসি। ১২ মিনিটে সক্রেটিসের গোলে সমতায় ফেরে ব্রাজিল। ২৫ মিনিটে আবারও গোল রসির। এবার ব্রাজিলকে ম্যাচে ফেরান ফ্যালকাও। ড্র ম্যাচে তখনো ব্রাজিলের সম্ভাবনা। তবে ৭৪ মিনিটে রসি নিজের হ্যাটট্রিক পূরণ করলে আর ম্যাচে ফেরা হয়নি সেলেসাওদের।

রাতারাতি দৃশ্যপট বদলে যায়। ভৎর্সনার বদলে পাওলো রসিকে নিয়ে শুরু হয় বন্দনা। সেটা আরও বহুগুণে বেড়ে যায় সেমিফাইনালে তার জোড়া গোলে ইতালি পোল্যান্ডকে হারালে। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি বাধা হতে পারেনি ইতালির তৃতীয় শিরোপা জয়ে। ৩-১ ব্যবধানের সে ম্যাচে প্রথম গোল করেছিলেন পাওলো রসি। ৪৪ বছর পর বিশ্বকাপ আসে ইতালির ঘরে। ছয় গোল করে গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল দুটোই জেতেন রসি। একই বছর তার হাতে উঠে ব্যালন ডি’অর।

এসএইচ-১১/২৯/২২ (স্পোর্টস ডেস্ক)