যে কারণে ব্যালন ডি’অর নেই পেলে-ম্যারাডোনার

সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি হিসেবে ফ্রান্স ফুটবল প্রতিবছর ব্যালন ডি’অর পুরস্কার দিয়ে থাকে। আগে বাৎসরিক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এ পুরস্কার দিলেও বর্তমানে প্রতি মৌসুমের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে দেয়া হবে এই মর্যাদাপুর্ণ পুরস্কার। ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই পুরস্কার জিতেছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ফুটবলার। তবে চমকে যাওয়ার মতো ব্যাপার হলো, ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা হিসেবে যাদের পরিচয়, সেই পেলে ও ম্যারাডোনা কখনোই জেতেননি এ পুরস্কার। এমনকি, তারা কখনো ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনয়নও পাননি।

১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই পুরস্কার প্রথমবার জিতেছিলেন স্যার স্ট্যানলি ম্যাথুজ। ২০১০ সালে ফ্রান্স ফুটবল ফিফার প্লেয়ার অব দ্য ইয়ারের সঙ্গে একীভূত করে এই পুরস্কার দিতে থাকে। তখন এর নাম হয় ফিফা ব্যালন ডি’অর। ২০১৫ সালের পর থেকে ফের আলাদাভাবে ব্যালন ডি’অর দিতে থাকে ফ্রান্স ফুটবল।

ফুটবল ইতিহাসের সেরা ফুটবলারদের মধ্যে অনেকেই পেয়েছেন এই মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার। আলফ্রেডো ডি স্তেফানো, ইউসেবিও, জার্ড মুলার, ইয়োহান ক্রুইফ, জর্জ বেস্ট, মিচেল প্লাতিনি, ফন বাস্তেন, রোনালদো নাজারিওরা আছেন ব্যালন ডি’অর জয়ীর তালিকায়। কেউ কেউ তো জিতেছেন একাধিকবারও। সর্বোচ্চ সাতবার জিতেছেন লিওনেল মেসি। পাঁচবার এই পুরস্কার জিতে দ্বিতীয় স্থানে আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এ ছাড়া মিচেল প্লাতিনি, ফন বাস্তেন, জিদান ও রোনালদো নাজারিও জিতেছেন একাধিকবার। তবে আশ্চর্যের বিষয়, সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে যে দুজনের নাম সবার আগে আসে, তারা কখনোই জিততে পারেননি এই পুরস্কার।

পেলে ও ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারে অসংখ্য অর্জন থাকলেও নেই ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের এই স্মারক। এমনকি, তাদের কখনো মনোনয়ন পর্যন্ত দেয়া হয়নি ব্যালন ডি’অরের জন্য।

১৫ বছর বয়সে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করা পেলে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টার পুরোটাই কাটিয়েছেন ব্রাজিলের ফুটবলেই। ইউরোপের লিগে কখনোই খেলেননি তিনি। ক্যারিয়ারের শেষদিকে অবশ্য কয়েকটা মৌসুম কাটান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল লিগে। নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে সকার লিগ মাতান সেখানে। ব্রাজিল জাতীয় দলে অভিষেকের পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জয় করেন পেলে। সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ গোল, হ্যাটট্রিক, ফাইনালে গোল ও শিরোপা জেতার রেকর্ড পেলেরই। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের পর জিতেছেন ১৯৬২ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপের শিরোপা।

গোলের পর গোল করে যাওয়া পেলের দখলে আছে বেশ কিছু রেকর্ড। শুধু গোল করাই নয়, পেলে ছিলেন পরিপূর্ণ এক ফুটবলার। তার সমসাময়িক কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য খেলোয়াড়ের চোখে পেলের সমকক্ষ ফুটবলার কখনোই আসেনি। অসংখ্যা ট্রফি ও ব্যক্তিগত পুরস্কার পেলের ব্যক্তিগত শোকেসে থাকলেও ব্যালন ডি’অরের জন্য কখনোই বিবেচিত হয়নি তার নাম।

পেলের পরবর্তী যুগে লাতিন আমেরিকার আরও অনেকেই মাঠ মাতালেও ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও ছিল না কেউ। এমনকি তৎকালীন ফুটবলজগতেই ম্যারাডোনার চেয়ে বড় কোনো তারকা ছিল না। দারুণ ক্যারিশমেটিক ফুটবলে সারা বিশ্বের ফুটবল সমর্থকদের মন জয় করেছিলেন তিনি। ১৯৮৬-র বিশ্বকাপে তিনি যা করেছেন, তার সমকক্ষ উদাহরণ নেই আর একটিও। একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে তিনি দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো বিশ্বকাপ জেতান। এরপরের আসরেও ফাইনালে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু জার্মানির কাছে হেরে কপাল পোড়ে তাদের।

ক্লাব ফুটবলে বার্সেলোনার হয়ে মাঠ মাতালেও ম্যারাডোনা খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন নাপলির হয়ে খেলতে গিয়ে। ইতালির মাঝারি সারির এই ক্লাবকে তিনি শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যান। জেতান লিগ শিরোপাও। নেপলসে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, রীতিমতো সে শহরের ঘরের ছেলেতে পরিণত হন। নেপলসবাসীর কাছে আরেক ঈশ্বর যেন ম্যারাডোনা। তবে পেলের মতো তার কপালেও জোটেনি ব্যালন ডি’অর।

এমন সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার সত্ত্বেও পেলে-ম্যারাডোনা কখনো ব্যালন ডি’অর জেতেননি মূলত নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে। ১৯৫৬ সালে এই পুরস্কারের চল শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ব্যালন ডি’অর শুধু ইউরোপিয়ান ফুটবলারদেরই দেয়া হতো। কোনো অ-ইউরোপিয়ান ফুটবলার এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতেন না।

পেলে তার ক্যারিয়ারে কখনোই ইউরোপে ফুটবল না খেললেও ম্যারাডোনা ইউরোপের বেশ কয়েকটি ক্লাবের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। বার্সেলোনা-নাপলি ছাড়াও খেলেছেন সেভিয়ার হয়ে। তবে ইউরোপিয়ান নাগরিক না হওয়ায় তাদের কেউই ফ্রান্স ফুটবলের এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হননি।

পেলে-ম্যারাডোনারা না জিতলেও দুবার ব্যালন জিতেছেন আরেক আর্জেন্টাইন ফুটবলার। আলফ্রেডো ডি স্তেফানো অবশ্য জিতেছেন স্প্যানিশ ফুটবলার হিসেবে। রিয়াল মাদ্রিদের এই কিংবদন্তি আর্জেন্টিনা ছাড়াও আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলেছেন স্পেন ও কলম্বিয়ার হয়ে।

এসএইচ-১২/১৭/২২ (স্পোর্টস ডেস্ক)