এ্যাম্বুলেন্স এলো না ৬ ঘন্টা- মৃত্যু হলো এই মায়ের !

এ্যাম্বুলেন্স

জি. এম. মুরতুজা: ছবিতে যে হাস্যেজ্জল নারীকে দেখছেন উনার নাম ফাতিমা শিপলা ফাইন। ডাক নাম শিপলা। বয়স মাত্র ২৯ বছর। বিয়ের পর দীর্ঘ ১২ বছর একটি সন্তানের জন্য শিপলা চিকিৎসা নিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের নামকরা অনেক ডাক্তারের। অনেক চিকিৎসা আর প্রতিক্ষার প্রহর গুনে অবশেষে মা হওয়ার সৌভাগ্য হয় শিপলার। মাত্র ১১ দিন আগে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন শিপলা। পরিবারে ফিরে আসে সুখ আর আনন্দের ঝলকানী। স্বামী সাইফুল ইসলাম আনন্দঘন পরিবেশে আকিকা দিয়ে নবজাতক শিশুটির নাম রাখেন ইরপিজা খান মানহা। সদ্য মা হওয়া শিপলা ও নবজাতক শিশু মানহা উভয়ই সুস্থ ছিল।

কিন্ত সন্তান জন্ম দেয়ার ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই গত চার দিন আগে প্রচন্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে শিপলার। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে নিকটস্থ আরবান হেলথ সেন্টারে করোনা টেষ্ট করা হয় শিপলার। করোনা টেষ্টে রেজাল্ট আসে পজেটিভ। এরপর আরো বেশী মাত্রায় অসুস্থ হয়ে গেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় শিপলার। চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়ীতেই অক্সিজেন সার্পোট দিয়ে করোনার চিকিৎসা নিচ্ছিলেন শিপলা। কিন্তু বুধবার দিবাগত রাত ১ টার দিকে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট শুরু হয় শিপলার। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে স্বামী সাইফুল ইসলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং রাজশাহী ফায়ার ব্রিগেডে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য অনবরত ফোন দিতে থাকেন। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন বাজলেও হাসপাতাল এবং ফায়ার ব্রিগেডের কেউই ফোন ধরেনি। বাধ্য হয়ে তিনি রাজশাহী মহানগরীর কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ্যান্বুলেন্সের জন্য ফোন দেন।

দুটি হাসপাতাল ও তিনটি ক্লিনিকের প্রতিনিধি সাইফুল ইসলামের ফোন ধরেন। কিন্তু করোনা রোগীর কথা শুনে তারা এ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে অপরগতা জানান। এরপর সাইফুল ইসলাম নিরুপায় হয়ে ফোন দেন ফেসবুকে এ্যাম্বুলেন্স সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া কয়েকটি গ্রুপের ফোন নম্বরে। কিন্ত তারাও কেউ ফোন ধরেনি। প্রায় ৬ ঘন্টা প্রানপণ চেষ্টা চালিয়ে একটি অটো রিক্সাও ম্যানেজ করতে ব্যার্থ হোন তিনি। ফলে শিপলা মারাত্মক খারাপ অবস্থায় উপনিত হয়।

বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৭ টার দিকে অতি কষ্টে রাজশাহী মডেল হাসপাতালের একটি এ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করে স্বাশকষ্টে নেতিয়ে পড়া শিপলাকে এই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল ৭ টার দিকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর সাড়ে ৮ টার দিকে চিরতরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সদ্য মা হওয়া শিপলা। এতিম হয়ে পড়ে মাত্র ১১ দিনের নবজাতক শিশু মানহা। মায়ের বুকের দুধপান করার জন্য অনবরত চিৎকার দিয়ে কেঁধে চলেছে শিশুটি। বাড়ীর কেউই পারছেনা শিশুটির কান্না থামাতে। শিপলার অকাল মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গেছে পরিবারের সকলে। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ঠিক সময়ে এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেলে বাঁচানো সম্ভব হতো শিপলাকে। কেননা তাকে বাঁচানোর জন্য দরকার ছিল হাইফ্লো অক্সিজেনের। যার ব্যাবস্থা আছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

কিন্তু তাকে এই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘ ৬ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়েও তারা একটি এ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করতে পারেনি কথিত শান্তি ও নিরাপদ শহর রাজশাহী মহানগরীতে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে মেহেরচন্ডি মধ্যপাড়ায় অবস্থিত বাড়ী থেকে মারাত্মক অসুস্থ সদ্য মা হওয়া শিপলাকে নেয়ার জন্য এ্যাম্বুলেন্স পাঠায়নি বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। এটা কেমন শান্তির নগরী! কেমন নিরাপদ নগরী! যেখানে এ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ার জন্য ১১ দিনের শিশুকে চিরদিনের জন্য এতিম করে দিয়ে একজন মায়ের অকালে মৃত্যু হয়। এটাই কি শান্তি ও নিরাপদ নগরীর নমুনা!

অথচ আমাদের মন্ত্রী ও সাংসদ ফেসবুকে বিনা খরচে এ্যাম্বুলেন্স সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফোন নম্বর দেন। সেই ফোন নম্বরগুলোতে চরম বিপদে পড়ে ফোন দিলে কেউ ফোন ধরে না। তবে কি দরকার এই ভাঁওতাবাজীর ফোন নম্বর দেয়া! মাত্র ১১ দিন বয়সে এতিম হওয়া এই নবজাতক শিশুটিকে কি জবাব দিবেন আমাদের শান্তি ও নিরাপদ নগরীর কর্নধারগণ। প্রশ্নটি রাখলাম আপনাদের নিকট?

আর যদি সম্ভব হয় এই অপমৃত্যুর পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার কার্যকর ব্যবস্থা নিবেন। শাস্তির আওতায় আনবেন অভিযুক্ত হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে। তবে হয়তো একটু হলেও শান্তি পাবে অকালে মৃত্যুর স্বাধ নেয়া শিপলার বিদেহী আত্মা। ১১ দিন বয়সে এতিম হওয়া শিশু মানহা বড় হয়ে জানবে তার মায়ের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। নগরীর সবাই জানবে কর্তব্যে, কর্মে, কার্যে অবহেলা করলে শাস্তি পেতে হয়। যদি এটা না করতে পারেন, তবে দয়া করে আপনাদের বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে আর রাজশাহীকে শান্তি ও নিরাপদ নগরীর তকমা দিবেন না।