অ্যালার্জি চুলকে অস্থির?

অ্যালার্জি চুলকে

ম্যারাথন চুলকানি! হঠাৎ করেই আরম্ভ হয়। প্রথম কিছু কামড়েছে ভেবে অবহেলা করলেই চুলকানির দাপট দ্রুত বাড়তে থাকে। তখন ক্ষণিকের মধ্যে শরীরের কিছু স্থানে চাকাচাকা ফুসকুড়ি বেরিয়ে যায়। সেই স্থান লাল হয়ে ফুলে ওঠে। কয়েক ঘণ্টার ভোগান্তির পর হঠাৎ করেই সব গায়েব। হাঁফ ছেড়ে নিস্তার। কিন্তু এমন চুলকানির অ্যাটাক মাঝে মধ্যেই যত্রতত্র শুরু হয়ে যায় অনেকেরই। কমে যাচ্ছে ভেবে কিছুক্ষণ চুলকানি সহ্য করে নিলেই সমস্যার সমাধান মনে করেন। এতে আশ্বস্ত না হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

চুলকানির সঙ্গে অ্যালার্জির যোগসূত্র

চুলকানি হল লক্ষণ আর অ্যালার্জি হল কারণ। যা অ্যালার্জেন্স ঘটিত। অর্থাৎ কোনও একটি বিশেষ উপাদান শরীর নিতে না পরলে তার প্রতিক্রিয়া অ্যালার্জি। অ্যালার্জিতে তাঁরাই বেশি আক্রান্ত যাঁদের রক্তে ইওসিনোফিলের মাপ বেশি। বেশিরভাগ সময় অ্যালার্জির ক্ষেত্রেও চুলকানিটা একটা লক্ষণ, কারণ শরীরের অ্যালার্জেনের প্রতিক্রিয়া বা বহিঃপ্রকাশ হল ইনফ্লেমেশন অর্থাৎ জ্বালা-যেটা চুলকানির রূপে প্রকাশ পায়। এই চুলকানি শরীরে যে কোনও স্থানে হতে পারে।

রোগগুলির নাম- মূলত তিন ধরনের রোগের জন্য বিভিন্ন অ্যালার্জেন্সের সংস্পর্শে শরীরে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ চুলকানি হয় এবং লক্ষণ গুলি কিছুটা হলেও মেলে।

– আর্টিকেরিয়া

– অ্যালার্জিক কনট্যাক্ট ডার্মিটাইটিস (এসিডি)

-অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস

এগুলির মধ্যে অ্যালার্জি কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস দীর্ঘমেয়াদি না এবং অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিসের মতো এই ক্ষেত্রেও প্রাথমিকভাবে রোগ ত্বকেই সীমিত থাকে, তাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক হল আর্টিকেরিয়া।

এই ধরনের চুলকানি কোথায় হয়

– ত্বকের চুলকানি

– শ্বাসনালি বা স্বরনালিতে চুলকানি। যা থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা, হাঁপানি, অ্যালার্জিক ব্রঙ্কাইটিসের সমস্যা দেখা দেয়।

-নাকের ভিতরে চুলকানি থেকে হাঁচি বা নাক থেকে জল পড়ার সমস্যা দেখা দেয়। যাকে বলে অ্যালার্জি রাইনাইটিসের সমস্যা দেখা দেয়।

লক্ষণ চিনুন

আর্টিকেরিয়া

মূল লক্ষণ হল ত্বকের যেকোনও স্থানে চাকা চাকা হয়ে লাল হয়ে যায়। তারপর ফুসকুড়ি বেরিয়ে মারাত্মক চুলকানি হতে থাকে। এই চুলকানি মুখের ভিতরে, ঠোঁটে, জিহ্বাতে, মাথায় চুলের মধ্যে, এমন কী স্বর যন্ত্রেও হতে পারে। তখন রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয় যা ভয়ানক রূপ নিতে পারে। চুলকানি এবং ফুসকুড়ি চলে যাওয়ার পর, আবার পরের দিন অথবা কয়েক সপ্তাহ পরে একই সমস্যা ফিরে আসতে পারে। উৎপত্তি ত্বকের যেকোনও স্থানে হতে পারে।

অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস

মূলত এটা জন্মগত অসুখ। যা বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। কারও ছোটবেলায় হয়, কারও বয়ঃসন্ধিকালে আবার কারও প্রাপ্তবয়সকালে হতে পারে। কারও ক্ষেত্রে আবার শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স অবধি বিভিন্ন রূপে এই ধরনের অ্যালার্জি প্রকাশ পায়। শিশুদের ক্ষেত্রে হলে ফুসকুড়ি মাথায়, হাতে, পায়ে এবং মুখে হয়। ছোটবেলায় হলে- কনুই, হাঁটু এবং গলায় ফুসকুড়ি হতে থাকে। বয়ঃসন্ধিকাল বা প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ফুসকুড়ি কবজি, গোড়ালি, চোখের পাতা, এবং হাঁটু ও কনুইয়ের ভাঁজে হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে আবার এই রোগ পরবর্তী জীবনে হাঁপানির এবং অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের আকার নেয়। অনেকে আবার মানসিক রোগেও ভোগেন। এছাড়া অনেকের পেটের সমস্যা, আর্থ্রাইটিস অথবা টাক পড়ে যেতে পারে।

কেন হয়?

মূলত এই ধরনের অ্যালার্জির চাররকম কারণ

খাদ্য- আমিষ খাদ্য যেমন, চিংড়ি মাছ, মুরগির মাংস, মটন, ডিম বা নিরামিষ খাদ্য যেমন বেগুন, মাসরুম, বাদাম, টমাটো থেকে এই ধরনের অ্যালার্জেন্স শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া যে কোনও ফুড প্রিজারভেটিভ বা আডিটিভ যেগুলো চাইনিজ খাবারে কিংবা প্যাকেট ফুডে থাকে তা থেকেও এমন হতে পারে।

ওষুধের প্রতিক্রিয়া- প্রধানত মৃগী রোগ বা খিঁচুনির জন্য যে ওষুধ দেওয়া হয় তা থেকেও অ্যান্টি-বায়োটিক ওষুধ থেকে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া যে কোনও অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক বা হোমিওপ্যাথি ওষুধ থেকেও অ্যালার্জি হয়ে এই রোগ দেখা দিতে পারে।

এন্ডোক্রিন গ্রন্থির সমস্যা- মূলত থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার ফলে যাঁরা হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত অর্থাৎ শরীরে প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন হচ্ছে না সেক্ষেত্রেও এই ধরনের অ্যালার্জির প্রবণতা দেখা দেয়।

কোনওরকম সংক্রমণ- কারও শরীরে কোনও স্থানে দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ থাকলে তাঁদের আর্টিকেরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেমন- দাঁতে গর্ত (ডেন্টাল ক্যারিজ), প্রতিনিয়ত সর্দিকাশি লেগে থাকা, গ্যাস অম্বল নিত্যদিনের সঙ্গী (এই সমস্যা এইচ পাইলোরি নামক ব্যাকটিরিয়ার জন্যও হয়), মূত্রনালিতে সংক্রমণ, চর্মে ফাংগাল ইনফেকশন থেকে আর্টিকেরিয়া দেখা দিতে পারে। অনেকক্ষেত্রেই আবার রোগীর আর্টিকেরিয়ার সঠিক কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না।

অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস মূলত দু’টি জিন-সিএআরডি ১১ এবং এফএলজি জিনের পরিবর্তনের জন্য হয়। এছাড়া অন্য জিনগত সমস্যার ফলেও এ রোগ হতে পারে।

রোজের ব্যবহার থেকে অ্যালার্জি

যে অ্যালার্জেনগুলির জন্য এই রোগ হতে পারে সেগুলি হল- ধূলিকণা, আরশোলা, ফুলের পরাগরেণু, পালিত পশুর লোম, পারফিউম স্প্রে বা ডিওডোর‌্যান্ট, পোকামাকড়ের কামড় থেকে, অত্যাধিক পরিমাণে খাদ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, রং এবং সাজসরঞ্জাম যেমন, কাজল, আই ল্যাশ, আই লাইনার বা চুলের রঙে(হেয়ার ডাই) ব্যবহৃত কালো রং (পিপিডি বা পিডিটি), সিঁদুর ইত্যাদি। এমনকী দুধ বা দুধের অন্যান্য প্রোডাক্ট, ভাত, সরষের তেল থেকেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।

অ্যালার্জেন নির্ধারণ

রোগী কোন অ্যালার্জিতে ভুগছেন সেটা চিহ্নিত করার জন্য গায়ে এক ধরনের পট্টি (প্যাচ) লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটাকে বলে অ্যালার্জি প্রোফাইল টেস্ট। যেক্ষেত্রে বিভিন্ন অ্যাল্যার্জেন্সের ক্ষেত্রে রোগীর আইজিই (অ্যালাজেন স্পেসিফিক ইমুনোগ্লোবিউলিন ই টেস্ট) মাপা হয়। এই প্যাচে খুব কম মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জেন্স বিদ্যমান থাকে। রোগীর শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্যাচ লাগানো হয়। দুই থেকে তিনদিন, বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৭ দিন অবধি সেই প্যাচ রোগীর শরীরে লাগানো থাকে। দেখা হয় যে রোগীর শরীরে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না। যে প্যাচ লাগালে অ্যালার্জি হচ্ছে, তা থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় তাঁর শরীরের অ্যালার্জির উৎস।

রেহাই কখন

অ্যালার্জির কারণ ঋতু হলে সেক্ষেত্রে শীতকালে বা বসন্তকালে (পরাগ রেণুর জন্য) অ্যালার্জির প্রবণতা দেখা যায়। ঋতু চলে গেলে সমস্যাও মিটে যায়। শরীরের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন ওষুধ দিয়ে আটকানো কঠিন তাই রিঅ্যাকশন হলে তখন সেই চুলকানি বন্ধ করার জন্য অ্যান্টি-হিস্টামাইন ওষুধ দেওয়া হয়। সবচেয়ে ভাল উপায় হল অ্যালার্জি প্রোফাইল টেস্ট করে রোগী যদি তার শরীরে অ্যালার্জেন্স কোনটা সেই ব্যাপারে অবগত থেকে তার সংস্পর্শে না আসেন তবে অ্যালার্জির সমস্যা রোধ করা সম্ভব।

আরএম-১৪/০৫/০৭ (স্বাস্থ্য ডেস্ক, তথ্যসূত্র: সংবাদপ্রতিদিন)