রোজা পালন করা থেকে বিরত থাকলে কঠোর শাস্তি

পবিত্র মাহে রমযানের রোজা পালনকারীদের জন্য যেমনি আল্লাহ অনেক সওয়াব ও সম্মানের কথা ঘোষণা করেছেন, তেমনি ইচ্ছাকৃতভাবে পবিত্র রমযানের রোজা পালন করা থেকে বিরত থাকলে তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এমন কি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে একটি রোজা ভাঙ্গলে তার জন্য কাফফারা আদায় করতে হয়। আর এ কাফফারাও বড় ধরনের। একটি রোজার জন্য কাফফারা হলো কোনো প্রকার বিরতি ছাড়া ৬০ দিন লাগাতার রোজা রাখা। যদি কারো কাফফারার রোজা আদায়ের শক্তি না থাকে, তাহলে একটি ফরয রোজার জন্য ৬০ জন মিসকিনকে দু’বেলা পেট ভরে খাওয়াবে অথবা একজন মিসকিনকে ষাট দিন দু’বেলা করে খাওয়াবে। প্রত্যেক মিসকিনকে প্রত্যেহ এক সাদকায়ে ফিতরার পরিমাণ আটা বা গম দিবে অথবা আটা বা গমের দাম দিবে। একই রমযান মাসে একাধিক রোজা ভেঙ্গে থাকলে একটি কাফফারা ওয়াজিব হবে। কিন্তু কাযা রোজা বিরতির সাথে বা বিরতিহীনভাবে আদায় করা যায়। যদি কাযা রোজা শেষ হওয়ার পূর্বে র্বুমান বৎসরের রোজা এসে পড়ে, তাহলে র্বুমান বৎসরের রোজা শেষে কাযা রোজা শুরু করতে হবে।
রোজার ফিদিয়া আদায় করা সর্ম্পকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আর যাদের জন্য তা (সিয়াম পালন) কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া তথা একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা।” [সূরা বাকারা :১৮৪]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, “আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- অশীতিপর বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা যারা রোজা পালনে অক্ষম। তাঁরা উভয়ে প্রতিদিনের বদলে একজন মিসকীন খাওয়াবেন।” [এটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (৪৫০৫)] ‘ফাতাওয়াল লাজনাদ্ দায়িমা (১০/১৯৮) তে এসেছে, যখন ডাক্তারগণ এই সিদ্ধান্ত দেন যে আক্রান্ত রোগের কারণে আপনি রোজা পালন করতে পারবেন না এবং এ রোগ থেকে সুস্থতাও আশা করা যায় না তখন আপনাকে বিগণ ও আগণ মাসগুলোর প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন মিসকীন খাওয়াতে হবে, যার পরিমাণ হল দেশীয় খাদ্যদ্রব্য যেমন খেজুর বা অন্য কোনো খাদ্যের অর্ধ স্বা’। যদি ছুটে যাওয়া দিনগুলোর সম সংখ্যক দিন একজন মিসকীনকে রাতের বা দুপুরের খাবার খাইয়ে থাকেন তবে তা যথেষ্ট হবে। কিন্তু অর্থদানের মাধ্যমে ফিদিয়া দিলে সেটা যথেষ্ট হবে না।

রোজা অবস্থায় অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু কিছু কাজ করে ফেলেন। আবার কেউ কেউ ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলেন। এসব কাজ করার পর তারা মনে করেন রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্তু বেশ কিছু কাজ আছে যা রোজা ভঙ্গ হয়েছে মনে করলেও মূলত রোজা ভঙ্গ হয়নি। যে সব কারণে রোজা ভঙ্গ হয়নি বরং মাকরুহ হয়, তা হলো, যদি কোন রোজাদার কোন কিছু মুখে দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে। কোন জিনিস দাঁত দ্বারা চিবালে। কিন্তু নিজের সন্তানকে প্রয়োজনবোধে শক্ত খাদ্য চিবিয়ে নরম করে দিলে তাতে রোজা মাকরূহ হবে না। নিজের স্ত্রীকে সঙ্গমের ইচ্ছা ব্যতীত চুম্বন করলে। চোখে সুরমা ব্যবহার করলে। বিনা প্রয়োজনে মিছওয়াক করলে, যদি দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গোঁফের ওপর তেল লাগালে। মিথ্যা কথা বললে। অপরের দুর্নাম রটনা করলে। অশ্লীল ও বেহায়াপনা কথাবার্তা বললে অথবা গালাগালি করলে। রোজাদার ইফতার না করলে। শরীরে ভিজা কাপড় জড়ায়ে রাখলে বা গরমের জ্বালায় বারবার কুলি করে ঠাণ্ডা লাগালে। দাঁতের ভিতর হতে ক্ষুদ্র কোন বস্তু বের করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললে রোজা মাকরূহ হয়ে যাবে। অশ্লীল গান-বাদ্য শ্রবণ করা। রোজাবস্থায় এমন কোন কাজ করা যাতে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোজা ভেঙ্গে ফেলার আশংকা হয়। কুদৃষ্টি থেকে চোখের হিফাজত না করা। সারাদিন নাপাক অবস্থায় থাকা। ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে থু থু জমা করে গিলে ফেলা। ঝগড়া-বিবাদ করা। ইত্যাদি কারণে রোজা ভাঙ্গবে না তবে রোজা মাকরুহ হয়ে যাবে বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।

এ ছাড়া রোজা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে। জিহ্বা দ্বারা রান্না করা খাদ্যদ্রব্যের লবণের পরিমাণ পরীক্ষা করে থু থু ফেলে দিলে। অনিচ্ছাকৃতভাবে মশা-মাছি, ধুলাবালি, গাড়ির ধোঁয়া গলার ভেতরে প্রবেশ করলে। রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার বা যৌনাচার করলে। রোজা অবস্থায় শরীরে বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে, চোখে সুরমা লাগালে। আতর বা অন্য কোন সুগন্ধি ব্যবহার করলে। ডুব দিয়ে গোসল করলে এবং কানে পানি ঢুকলে রোজা নষ্ট হবে না।

রমযান মাসের মধ্যে যদি কোন অমুসলমান মুসলমান হয়, অথবা কোন নাবালেগ বালেগ হয় তবে তাদের ওপর পরবর্তী রোজাগুলো ফরজ হবে। বিগত দিনগুলোর রোজা কাযা করার প্রয়োজন হবে না। তবে উন্মাদ ব্যক্তি মুসলমান ও বালেগ হলেও সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার উপর রোজা ফরজ হবে না। তবে সে যদি রমযান মাসের কোন অংশে সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে এই রমযানের দিনগুলোর রোজা রাখা তার জন্য ওয়াজিব হবে। তেমিনভাবে হায়েয-নেফাসগ্রস্ত স্ত্রীলোক যদি রমযানের মধ্যে পাক হয়ে যায় অথবা অসুস্থ ব্যক্তি যদি সুস্থ হয়ে ওঠে কিংবা কোন মুসাফির যদি মুকীম হয়ে যায় তবে রমযানের দিনগুলোর রোজা তাদের পক্ষে ওয়াজিব হবে।

ইসমাঈল (রহঃ) আবু বাকর ইবনু ‘আব্দুর রহমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতার সঙ্গে রওয়ানা হয়ে ‘আয়িশা (রাঃ)-এর নিকট পৌঁছলাম। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লালআহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি ইহতিলাম ছাড়া স্ত্রী সহবাসের কারণে জুনুবী অবস্থায় সকাল পর্যন্ত থেকেছেন এবং এরপর সাওম (রোজা) পালন করেছেন। তারপর আমরা উম্মে সালামা (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনিও অনুরূপ কথাই বললেন। আবু জা’ফর বলেন, ‘আবদুল্লাহ (রহঃ)- কে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোন ব্যাক্তি সাওম (রোজা) ভঙ্গ করলে সে কি স্ত্রী সহবাসকারীর মত কাফ্ফারা আদায় করবে? তিনি বললেন, না; তুমি কি সে হাদীসগুলো সম্পর্কে জানো না যাতে বর্ণিত আছে যে, যুগ যুগ ধরে সাওম (রোজা) পালন করলেও তার কাযা আদায় হবে না? (সহীহ বুখারী)

‘উসমান ইবনু আবু শায়বা (রহঃ) আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, এই হতভাগা স্ত্রী সহবাস করেছে রমযানে। তিনি বললেন, তুমি কি একটি গোলাম আজাদ করতে পারবে? লোকটি বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি ক্রমাগত দু’মাস সিয়াম পালন করতে পারবে? লোকটি বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি ষাটজন মিসকীন খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না। এমতাবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এক ‘আরাক অর্থাৎ এক ঝুড়ি খেজুর এল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এগুলো তোমার তরফ থেকে লোকদেরকে আহার করাও। লোকটি বলল, আমার চাইতেও বেশি অভাবগ্রস্ত কে? মদীনার উভয় লাবার অর্থাৎ হররার মধ্যবর্তী স্থলে আমার পরিবারের চাইতে অধিক অভাবগ্রস্ত কেউ নেই।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তোমার পরিবারকেই খাওয়াও। (সহীহ বুখারী) ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী আয়িশা এবং উম্মু সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তাঁরা উভয়ই বলেন, রমযান মাসে ইহতিলাম ছাড়াই স্ত্রী সহবাসের কারণে জানাবাতের অবস্থায় রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভোর হতো, এরপর তিনি সাওম (রোজা) পালন করতেন। (সহীহ মুসলিম)।

এসএইচ-০১/১১/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)